বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফেসবুক পোস্ট ও মানুষের স্নায়ুযুদ্ধ

  • সম্পাদকীয়   
  • ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ২১:৫২

মানব শরীরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে তার স্নায়ু। এটি এতোটাই নিয়ন্ত্রণহীন যে মানুষ প্রতিনিয়ত সচেতনভাবে যে কাজগুলো থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করে সে কাজগুলো পুনরায় মুহূর্তেই তার দ্বারা সংগঠিত হয়। মানুষের এই অতি প্রতিক্রিয়াশীল স্নায়ু বর্তমান ফেইসবুক নামক যোগাযোগ মাধ্যমটি দ্বারা সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে বিভিন্ন যন্ত্র মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করেছে যা নানান ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মানবজীবনে। এর মধ্যে ফেইসবুক সবচেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল যোগাযোগ মাধ্যম। যদিও এর নাম যোগাযোগ মাধ্যম তবুও এর কাজ অনেক ক্ষেত্রেই মানুষে-মানুষে যোগাযোগ সৃষ্টির পরিবর্তে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করছে। মানুষের মনোজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো তারা অতি দ্রুত ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। এতে অন্যজন ভিন্ন ভিন্নভাবে সে ব্যক্তির উপর ক্রুদ্ধ হন। সমাজে হিংসা- প্রতিহিংসা যদিও সব সময়ই ছিল, তবুও তা ছিল কিছুটা স্তিমিত, ও আভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু এখন প্রায় সবকিছুই উন্মুক্ত। মানুষের বিদ্বেষও এখন ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে বাইরে আসে যা মানুষকে পূর্বের তুলনায় প্রকাশ্যে আরো বেশি হিংস্র করে তোলে। মানুষকে এখন ফেইসবুক পোস্ট নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে মানুষ ব্যক্তিগত জল্পনা-কল্পনা জুড়ে মনগড়া সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এতে যে কেবল মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয় তা শুধু নয়, মানুষ এতে হিংস্র ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। ফেসবুক হয়ে গেছে মানুষের মাঝে বিদ্যমান হিংসা ও ভালোবাসা প্রদর্শনের মাধ্যম যা মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে সকল প্রজন্মের মানুষের কাছে। বর্তমানে অনেকেই ফেসবুক স্বর্বস জীবন যাপন করছেন। ফেইসবুকে তাই চলছে নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত অবাধ প্রতিযোগিতা পূর্ণ প্রদর্শন। মানুষ এখন অনেক বেশি দেখাতে পছন্দ করে। যদিও এটি সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক বা দৃষ্টিকটূ নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের প্রদর্শনীটা দৃষ্টিকটূ। এর প্রধান কারণ হলো আমরা ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিদিষ্ট প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি না। আমরা ফেসবুকের একটি ওয়ালে ততধিক প্রজন্ম একত্রে থাকি। তাই ফেসবুক পোস্ট করার ক্ষেত্রে প্রাইভেসি রাখি না। এক প্রজন্মের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ বা আনন্দের, অন্য প্রজন্মের কাছে অস্বস্তিকর। এর মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো এখানে অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যেহেতু আমরা মোটা দাগে ফেসবুক পোস্ট সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা করি, সেহেতু কারো কোনো উদ্দেশ্যপূর্বক দেওয়া পোস্টকে আমরা প্রায় অনেকেই নিজের গায়ে নেই। অনেকেই মনে করে অমুক তমুক পোস্ট আমাকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যক্তিগত দ্বেষ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল বিষয়ে সন্দেহ করেও একেকটি পোস্ট বা কথা একেকটি সম্পর্ককে নষ্ট করে। মানুষ যখন সরাসরি কারো প্রতি কোনো আক্রোশ প্রকাশ করতে পারে না, তখন সে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে তা প্রকাশ করে। তখন বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায় ছাপিয়ে সামষ্টিক অসম্মানের পর্যায়ে চলে যায় যার সুবিধাও নেয় অনেকে। এরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় মানুষ আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, ফেইসবুক পোস্ট বর্তমানে তৈল প্রদানের একটি লাভজনক জায়গায়ও পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা ও তৈল প্রদান হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্যসঙ্গী। মানুষ শত্রুতা প্রকাশও দশজনের সামনে ফেইসবুক পোস্টের মাধ্যমে করে, ভালোবাসা প্রকাশও ঠিক একইভাবে করে। ফলে গোপন থাকে না কিছুই। দানা বাধে নতুন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। ফেসবুক পোস্ট বর্তমানে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। ফেসবুকে সহজেই কিছু একটা দেখে, তার জনপ্রিয়তা দেখে মানুষ অতি সহজে তা বিশ্বাস করে। এটি ভয়ংকর পরিণতির দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। কেননা, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। অহর্নিশি মানুষ ফেইসবুকের সেই পোস্টকে বিশ্বাস করে প্রভাবিত হয় যা দেওয়ার সময় পোস্ট প্রদানকারী ব্যক্তি দু'বারও ভাবে না যে সে কী লিখছে। অর্থাৎ দুর্বল মানসিক অবস্থায় না বুঝে পোস্ট করা বিষয় দ্বারাও একটি বিরাট অংশের মানুষ মনো বিকারে ভোগে। ফেসবুকে পোস্টের আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো কমেন্ট করার সহজসাধ্য উপায়। যে বিষয়টিই মানুষের ব্যক্তিগত মতকে সমর্থন করে না সে বিষয়কে কেন্দ্র করে মানুষ অত্যন্ত বিশ্রি ভাষায় অশ্রাব্য উদগীরণ করে যা মানুষে- মানুষে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে। জন্ম হয় নতুন ঘৃণার। মানুষ যে মানুষকে এত ঘৃণা করে তা ফেইসবুকই মানুষের সামনে নিয়ে এসেছে। অন্যভাবে বলতে হয়, ফেসবুকে অন্যের গুণগান না জনপ্রিয়তা মানুষের স্নায়ুকে নেতিবাচকভাবে পরিচালিত করে। এ থেকে পাল্টা আক্রমণের স্নায়ু যুদ্ধ হয় যার বিরতি ঘটে তখন যখন অন্য প্রান্তে ভিন্ন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজে। এ থেকে মানুষের পরিত্রাণ জরুরি। নয়ত মানুষ যন্ত্রকে নয়, যন্ত্র পরিচালনা করবে মানুষকে। এর ধারাবাহিকতায় ধ্বংস হবে মানবসভ্যতা, যন্ত্রের তলে পৃষ্ঠ হবে মানবতা।

লেখক: শারমিন সুলতানা, শিক্ষক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

এ বিভাগের আরো খবর