মৌলিক অধিকারের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত খাদ্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা-ই আজ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি একের পর এক গবেষণায় বেরিয়ে আসছে ভয়াবহ তথ্য- মাছ, শাকসবজি, ফলমূল, দুধ, ব্রয়লার মুরগি এমনকি টি-ব্যাগেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও ক্ষতিকর ভারী ধাতু। এসব উপাদান ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসসহ নানা দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস এবং সবজির মতো প্রতিদিনকার অপরিহার্য পণ্যের দাম যখন আগেই নাগালের বাইরে, তখন নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে জনগণের জন্য ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যাদের আয় সীমিত; কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সম্মান রক্ষার কারণে তারা সব দিক থেকে বিপদে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে বোতলজাত ও খোলা উভয় ধরনের সয়াবিন এবং পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। তাদের দাবি- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও মূল্য সমন্বয় প্রয়োজন। অথচ বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য বলছে, আগের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম নিম্নমুখী ছিল। সেখানে পরবর্তী এপ্রিল-জুন; এমনকি গত জুলাই মাসেও উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। তবে গত আগস্টে সয়াবিন তেলের বাজার আবার নিম্নমুখী রয়েছে। জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ১ হাজার ৩০৭ ডলার ছিল, যা আগস্টে ১ হাজার ২৪৫ ডলারে নেমেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- দাম বাড়ানোর এই তাড়া কোথা থেকে এলো?
বর্তমানে রাজধানীর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৮-১৯০ টাকা, আর খোলা তেল ১৭০-১৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৪-১৬ শতাংশ। এখন যদি আরও ১০ টাকা বাড়ে, তাহলে একটি গড় পরিবারের জন্য মাসিক খরচ বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশেষ করে যেখানে আয় বাড়েনি, চাকরি বা পেশার স্থায়িত্ব নেই, সেখানে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি অনেক পরিবারের আর্থিক ভারসাম্য ভেঙে দিতে পারে।
ভীতিকর আরো বিষয় হলো পাস্তুরিত দুধেও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, এমনকি অপাস্তুরিত দুধে ফরমালিন ও ডিটারজেন্ট মিশ্রণের প্রমাণ মিলেছে। টি-ব্যাগেও সিসা, পারদ, আর্সেনিক- যেগুলোর প্রতিটিরই সীমা ছাড়িয়ে গেছে কয়েকগুণ- তা প্রমাণ করে খাদ্য সুরক্ষা আজ কতটা হুমকির মুখে। এখন প্রশ্ন হলো- এত সব গবেষণার ফলাফল সামনে আসার পরও সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ কোথায়?
দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে পণ্যমূল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের একটি গোপন আঁতাত ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিরবতা অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিবেচনায় নিলেও সেটি যাচাই- বাছাইয়ে স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। ক্যাবসহ অন্যান্য ভোক্তা সংগঠন বহুবার দাবি জানালেও এ ধরনের সিদ্ধান্তে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার বদলে সিদ্ধান্তগুলো ব্যবসায়ী স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। এর ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে প্রতি মাসেই নতুন করে হিসাব কষে সংসার চালাতে হয়। মনে রাখতে হবে- মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমস্যা উচ্চবিত্তর চেয়ে ভিন্ন। তারা উচ্চবিত্তের মতো ব্যয় বহন করতে পারে না। মধ্য বিত্তরা সরকারি সহায়তার আওতায়ও পড়ে না। নিম্নবিত্তের জন্য সহায়তাও অপ্রতুল। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে তাদের হাতে বিকল্প থাকে না। পুষ্টিকর খাদ্য বাদ দিয়ে কমদামি; কিন্তু স্বাস্থ্যহানিকর বিকল্প বেছে নিতে হয়। তাদের সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে গিয়ে স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- দাম কমলে কেন তা বাজারে প্রতিফলিত হয় না?
এই খাদ্যদূষণ মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ার মতো কাজ করে। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, বন্ধ্যত্ব, শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তাই এর প্রতিকারে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, নইলে পরিণতি হবে বিপর্যয়কর। সরকারি পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএফএসএকে নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে হবে। দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে।
সরকারকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে এখনই, নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক ভয়ানক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে- যার দায় এড়ানো কারও পক্ষে সম্ভব হবে না।তাই বাস্তবতাকে অনুধাবন করে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক গবেষক মানবাধিকারকর্মী।