তখন আমার বয়স নয়-দশ বছর হবে। একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছিলাম। গ্রামের সাথে উপজেলা সদরের একমাত্র সংযোগ রাস্তাটি ইট বিছানো ছিল। যানবাহন বলতে সাইকেল, সাইকেল, ভ্যান, গরুর গাড়ি এবং সারাদিনে দুই-চারটে মোটরসাইকেল। কয়েক বছর এভাবে চলতে চলতে রাস্তার ইটগুলো ক্ষয়ে যেয়ে বালু এবং ইটের সুক্ষ গুড়ো মিলে রাস্তার ওপর এক-দেড় ইঞ্চির লালচে ধুলোবালির আস্তরণ জমা হতো। যানবাহনের চলাচল এবং বাতাসে ধুলো উড়ে রাস্তার দুধারের গাছগুলোর পাতা লালচে হয়ে থাকত। যাই হোক, ভর দুপুরে একা হাঁটতে হাঁটতে এক ধরনের মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার পাশের খেত থেকে পোকা-মাকড়ের শব্দ ছাড়া একদম নীরবতা। দুই-তিন মিনিট ধরে হাঁটছি; কিন্তু একজন মানুষেরও দেখা মিলছে না। কিছুক্ষণ পরপর পেছনে তাকিয়ে লাল ধুলোয় নিজের ফেলে আসা পায়ের চিহ্ন দেখে মজা পাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো ‘আমি কে?’ ওই পায়ের ছাপ ফেলে আসা মানুষটা আমি নাকি যে পায়ের ছাপটা দেখছে সে আমি? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে মুহূর্তটাই প্রথম যখন আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেদিন থেকে আমি আজ পর্যন্ত আমার সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি যে আমি আসলেই কে।
এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো অনেকেই মনে মনে ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা, আমি কে সেটা আমি জানব না? কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক এবং জটিল প্রশ্ন এটাকেই ধরা হয় যে ‘আমি কে?’ আমি কে সেটা জানার আগে নিজেকে পরিষ্কার করতে হবে যে আমি আসলে কোন মতবাদে বিশ্বাসী। অনেকের মতে আমার শরীরই আমি। অর্থাৎ আমিত্বর মধ্যে আধ্যাত্মিক বা কাল্পনিক বা আনুমানিক কিছু নেই। যাকে দেখা যাচ্ছে সেই আমি। আমাদের শরীর যখন অকার্যকর হয়ে যায় তখন সেটাকে আমরা মৃত্যু বলি। এই মৃত্যুর সাথে সাথে আমার অস্তিত্ব এ মহাজগৎ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যদিও এর মধ্যে আরেক প্রকারের চিন্তক আছেন যারা মনে করেন যে মৃত্যুর পর আমাদের যে এনার্জি আছে সেটা এই মহাবিশ্বের অন্যান্য এনার্জির মধ্যে ছড়িয়ে যায়। আরেকটু ব্যাপকভাবে আমাদের মৃত্যুর মাধ্যমে আমদের কনশাসনেস বা চৈতন্য বিলুপ্ত হলেও আমাদের এনার্জি মহাজগতের সাথে মিশে এটারনিটি পেয়ে যায়। এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আমার চৈতন্য শেষ হয়ে গেলে আত্মিকভাবে ইনট্যাক্ট আমি কিন্তু আর থাকতে পারব না।
আরেকটা মতবাদ হচ্ছে আমাদের শরীর এবং আত্মা দুটো ভিন্ন কিছু । এই মতবাদে শরীর হচ্ছে নশ্বর এবং আত্মা অবিনশ্বর। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আত্মা ছাড়া শরীর টিকতে পারে না; কিন্তু শরীর ছাড়া আত্মা টিকতে পারে। বর্তমানে আরেক ধাপ এগিয়ে অনেকে বডি, সউল এবং স্পিরিট এই তিন ভাগেও আমাদের বিভাজিত করে যার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থিতি রয়েছে। আজকে আর সে আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না।
এবার আসেন আমরা আবার আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাই। আমি কে? আপনারা যে আমাকে দেখছেন সেটাই কি আমি নাকি যে আমি আজকের লিখাটা চিন্তা করেছি সেটাই আমি? অথবা যে আপনি পত্রিকা হাতে নিয়ে বসে আছেন সেটাই কি আপনি, নাকি যে এই লেখাটা পড়ে কল্পনা করছে সেটা আপনি? অনেকে হয়তো ভাবছেন, যে আমি হেঁটে যাই তাকেই তো মানুষ নাম ধরে ডাকে। আমার শরীর দেখেই তো মানুষ আমাকে চিনে, আমার আত্মাকে কি কেউ দেখেছে, নাকি চিনে? আমার শরীরকেই তো মানুষ নাম দেয়, আত্মাকে না। হয়তো তাই; কিন্তু এ বিষয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
মনে করেন, আমরা লতিফ নামে একজনকে জানি বা চিনি। কোনো এক দুর্ঘটনায় যদি সেই লতিফের একটা হাত কেটে যায় তাহলে সেই অবস্থাকে আমরা কী বলব? হাতটাকে কি কোনোভাবে লতিফ বলা যাবে? বা হাত ছাড়া কি লতিফের ভিন্ন কোনো পরিচিতি হবে? একইভাবে যদি দুহাত এবং দুপা কেটে যায় তাহলে কী অবস্থা হবে? আমরা বরং আরও সরাসরি একটা অবস্থাতে যাই। সেই লতিফ যদি মারা যায় তাহলে আমরা কী বলি? সাধারণত বলি যে লতিফ মারা গেছে। প্রথমত লতিফ তো উধাও হয়ে যায়নি, তার শরীরটা তো রয়েছে। তারপরেও কেন আমরা বলি যে লতিফ মারা গেছে? তারচেয়ে বড় কথা তার শরীরটাকে লাশ বা বডি বলি কেন? কেন আমরা মৃত মানুষকে সরাসরি নাম ধরে সম্বোধন করতে অস্বস্তি বোধ করি? মারা যাওয়া বলতে আমরা আসলেই কী বোঝাই?
আমার মনে হয় আমাদের শরীরটা এ পৃথিবীর উপাদান এবং আত্মাটা ভিন্ন এক পৃথিবী বা জগতের উপাদান। মায়ের গর্ভাশয়ে ভ্রূণ থেকে যখন শরীরটা ক্রমশ পূর্ণতার দিকে যেতে থাকে এবং যে মুহূর্তে সেই শরীর আমাদের আত্মাকে ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করে তখন আমাদের আত্মা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। এই শরীর এবং আত্মার সমন্বয়ে আমি। একটা দৃশ্যমান এবং আরেকটা অদৃশ্য উপাদানের এক রহস্যজনক মিশ্রণে এই আমি। কেন এবং কীভাবে এই আত্মা এসে শরীরে ভর করে এবং কোন প্রক্রিয়ায় একটা আত্মা আরেকটা শরীরকে নির্ণয় বা পছন্দ করে নেয় সেটা আরেক রকমের দর্শন এবং এর সাথে কিছু ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যাও আছে। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না।
বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার এবং বিজ্ঞানী ডেয় কাট (Descartes) তার চিন্তা-শক্তি নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন যেটা এখন একটা বিখ্যাত ফিলোসফিক্যাল আইডিয়া এবং ডেয় কাটের মূল দর্শনের ভিত্তি। যদিও তিনি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে ল্যাটিন ভাষায় ‘কজিটো এরগো স্যুম’ বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর বাংলা ভাবার্থ হচ্ছে, ‘আমি আমার অস্তিত্ব উপলব্ধি করি কারণ আমি চিন্তা করতে পারি’। ডেয়কাটের মতে আমাদের চিন্তা-শক্তিই আমাদের উপস্থিতি জানান দেয়। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে আমরা যে চিন্তা করি সেটা আসলে কার উপলব্ধি। আমাদের আত্মার, নাকি আমাদের শরীরের, নাকি আমাদের ব্রেইনের। আমাদের চিন্তা এবং অনুমান; কিন্তু জটিল থেকে জটিলতর হওয়া শুরু করেছে।
আমার মনে হয় আমাদের আত্মা এ পৃথিবীর কোনো উপাদান দিয়ে তৈরি না। এ কারণেই এ পৃথিবীর কোনো ফিজিক্স বা সায়েন্স দিয়ে আমাদের আত্মাকে ব্যাখ্যা করাত সম্ভবই না, এমনকি আত্মা সম্পর্কে কিছু অনুমান করাও অনেকটাই অসম্ভব। অন্য অজানা ফিজিক্সের অংশ আমাদের এই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করতে এ পৃথিবীর উপাদানের সাহায্য নিতে হয়। আমাদের শরীর হচ্ছে সেই উপাদান। আমরা জানি যে আমাদের সকল চিন্তা, অনুমান, কাজ, উপলব্ধি কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আমাদের আত্মার সাথে আমাদের মস্তিষ্কের সম্পর্কটাই আমাদের মেনিফেস্টেশন। আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের সাথে যত ভালো সমন্বয় থাকবে তত সুন্দরভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করতে পারব। অন্যভাবে বললে, আমাদের অপার্থিব আত্মাকে এই পৃথিবীর সাথে সমন্বয় ঘটায় আমাদেরই পার্থিব মস্তিষ্ক। আমার মতে আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের সমন্বয়হীনতা বা বিচ্ছিন্নতাকেই আমরা মৃত্যু বলি।
আমাকে দেখে আমাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আমার শরীরটা আমার বডি বা লাশ। সেই বডি নিজে থেকে কিছু করতে পারে না যতক্ষণ না আত্মা মস্তিষ্কের মাধ্যমে নির্দেশনা দেয়। তাই আমার শরীরের কর্ম আসলে আমার আত্মার কর্ম। আমার মুখের কথা আসলে আত্মার কথা। আমার শরীর একটা কন্ট্রোল পুতুল ছাড়া আর কিছুই না। যার আত্মার সাথে তার শরীরের সমন্বয় যত ভালো সে তত জ্ঞানী। এটাকে উল্টিয়ে বললে দাঁড়ায়, যে যত জ্ঞানী সে তত ভালোভাবে তার আত্মার সাথে শরীরের সমন্বয় ঘটাতে পারে। একারণেই যুগ যুগ ধরে মনিষীরা বলে গেছেন ‘নিজেকে জানো’। এই নিজেকে জানা মানে কিন্তু অনেক ব্যাপক কিছু। শুধু নিজের নাম, পরিচয়, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের মধ্যে ভালো সমন্বয় নেই বলে আমরা জানি না পরের মুহূর্তে আমরা কী করব বা কী ভাবব। এই সমন্বয়হীনতার জন্যেই আমাদের নিজেদের ওপর নিজেদের কন্ট্রোল নেই। ভালো কাজ এবং মন্দ কাজের পার্থক্য বোঝতে পেরেও মন্দ কাজকে বেছে নেই। আসুন আমাদের আত্মা এবং মস্তিষ্কের একটা দারুণ সমন্বয় ঘটানোর জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত এই বডিটাকে রেখেই তো উড়াল দিতে হবে, তাই না?
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার।