তখন ক্লাস ফাইভ অথবা সিক্সে পড়ি। সবে সকালের আলো ফুটেছে। আম্মা আমাকে ডেকে তুললেন। আব্বা এবং মতিন কাকা উঠানে অপেক্ষা করছেন। আমরা একসাথে হাটে যেয়ে আম, কাঁঠাল কিনে আনব। এক্সাইটমেন্ট থেকে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে উঠানে চলে এলাম। উঠানের পশ্চিম পাশে মতিন কাকার নৌকা বাঁধা। আব্বা এবং কাকা এর মধ্যেই নৌকায় উঠে পড়েছেন। আমি কাঁচুমাচু করে ভদ্র ছেলের মতো নৌকায় উঠে বসলাম। মতিন কাকা নৌকা বাওয়া শুরু করেছেন। আমাদের নৌকা উত্তর দিকের বিল ধরে চলা শুরু করেছে। দক্ষিণ দিক থেকে আসা সোঁ সোঁ বাতাস পানিতে বৈঠা এবং নৌকার সম্মুখভাগের আছড়ে পড়া পানির শব্দের সেই মাদকতা যারা কখনো উপভোগ করেনি তারা বুঝতে পারবে না। যাই হোক, কয়েকটি বিল এবং একটি বড় খাল ও একটা ছোট নদীর কিছুটা অংশ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা হাটে পৌঁছলাম। ছোট একটা দ্বীপের মত এলাকায় হাটটি। উপরে পাতার ছাউনি দেয়া এবং চারিদিকে খোলা বেশ কিছু দোকান মিলে এই হাট। খাল, নদীর তাজা মাছ, আশ পাশের এলাকা থেকে উৎপন্ন টাটকা সবজি এবং আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচুতে ভরপুর।আমরা আম, কাঁঠাল কিনে আবার দুই/তিন কিলোমিটারের সেই টলটলে পানি ভেদ করে বাসায় ফিরে আসলাম।
উপরের লেখাটা এ পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন যে আমি কোন এলাকার গ্রামের কথা বলছি? আবার অনেকে হয়তো নিজের বা নানাবাড়ির গ্রামের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। মজার বিষয় কি জানেন? আমি যে এলাকা এবং হাটের কথা বললাম সেটা ঢাকা শহরেই অবস্থিত। আমি মাদারটেক থেকে বনশ্রীর মেরাদিয়া হাটে যাওয়া আসার কথা বললাম। অনেকের কাছে কল্পকাহিনী মনে হলেও এটা একদমই সত্য। তখন মূল ঢাকা শহর খুব অল্প জায়গায় বিস্তৃর ছিল। চার দিকে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষাসহ কয়েকটা নদী এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক খাল এবং বিল। মার্চের শেষের দিকে নদীর পানি বিভিন্ন নিচু এলাকায় খালের মাধ্যমে ঢুকে যেত। অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত পানিতে ভেসে থাকতো অনেক এলাকা। রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার সংক্ষেপে আর ডি আর সির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রায় ১৭৫টি খাল, লেক এবং পানি প্রবাহের চ্যানেল ছিল। বর্তমানে ৮০টির কোন অস্তিত্ব নেই এবং পনেরটি নামে মাত্র টিকে আছে। ১৮৮০ থেকে ১৯৪০ এর সি এস ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে পানি প্রবাহ ছিল প্রায় ৩২৬ কিমি যা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০৬ কিমি। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ পানি প্রবাহের চ্যানেল বিলীন হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে সেগুলো গেল কোথায় বা তার বর্তমান অবস্থা কি? উত্তর খুব সহজ। দখল হয়ে গেছে, কেনা বেচা হয়ে গেছে। যাদের দেখার দায়িত্ব ছিল তারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। এরচেয়ে বেশী কিছু বললে মানহানির মামলায় পড়ে যেতে পারি।
ছোটবেলায় দুপুরের খাওয়ার পর থেকে বিকেলের আসরের আযান হওয়া পর্যন্ত এক ধরণের উৎকণ্ঠায় থাকতাম। আযান পড়লেই খেলার মাঠের উদ্দেশে দৌড়। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটা এলাকাতেই খেলা ধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। বিকাল পড়লেই ছোট ছেলে মেয়েদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে দারুণ একটা আবহ তৈরি হতো। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন,সাতচারা ইত্যাদি খেলার আয়োজন। পরীক্ষা চলাকালীন সময় ছাড়া কেউ বিকেলের খেলা মিস করতে চাইতো না।এখন এই শহরে বাচ্চারা খুব একটা খেলে না। কিছু ছেলে মেয়ে হয়তো কিছু টাকা দিয়ে কোন একাডেমী বা ক্লাবের আন্ডারে খেলে; কিন্তু সেই সবাই এক হয়ে খেলার পরিবেশ আর নেই। সবচেয়ে বড় কথা খেলবেটা কোথায়? বর্তমানে হাতে গোণা কিছু মাঠ। তাও দেখি মাঠগুলো উন্মুক্ত না। ভাড়ায় চলে।
আমরা ছোটবেলায় যে ঢাকা শহর দেখেছি সে ঢাকার চেয়ে এই ঢাকা অনেক আধুনিক, অনেক সুসজ্জিত। বড় বড় অট্টালিকায় ঢাকার আকাশ এখন ছেয়ে গেছে।হাজার হাজার গাড়িতে রাজপথ পরিপূর্ণ। যেটা নেই সেটা হচ্ছে বসবাসের উপযোগিতা। ধুলা বালি আর কালো ধোঁয়ায় একাকার। রাস্তায় হাটলে কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য বাতাস খোঁজা লাগে।
একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন তো, ঢাকা শহরে মোটামুটি সুস্থ্যভাবে বসবাসের জন্যে এখন সবচেয়ে বেশি কি কি প্রয়োজন? আমি মনে করি প্রথমে দরকার একটা সহনীয় পরিবেশ। ঢাকার পানি খারাপ, ঢাকার বাতাস খারাপ, ঢাকায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব। ঢাকায় যে কয়েকটা লেক বা পানি প্রবাহের চ্যানেল আছে সেগুলার দিকে একটু তাকান। দেখলে মনে হবে ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকে ঢাকা রাস্তা। কিছু বছর আগেও যেসব খাল দিয়ে টলটলে পানি প্রবাহিত হয়ে যেত, যে সব খালে আমরা ডুব সাঁতার খেলেছি সেগুলো এখন নিছক ড্রেন হিসাবে পড়ে আছে। এই দৃশ্য যে কতটা মর্মান্তিক সেটা শুধু তারাই বুঝবে যারা এই দুটো বৈপরীত্য নিজ চোখে দেখেছে।
বাচ্চারা যখন বিকেলে খেলাধুলা করে তখন এক ধরনের কিচির মিচির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে যেটাতে অনেকটা শেষ বিকেলে পাখিরা ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নেয়ার সময় যে আওয়াজ করে তার সাথে মিল পাওয়া যায়। বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতায়, মনের প্রশান্তিতে এবং পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার জন্যে বিকেলে খেলা ধুলা করা যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা আমরা অনেকেই জানি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে নজর না দিয়ে নগরায়নের নামে মাঠ দখল করা বা খেলার মাঠে স্থাপনা কতটা অযৌক্তিক সেটা বলার প্রয়োজন নেই। সমস্যা হচ্ছে, আমরা কেন যেন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যাই। প্রতিটা এলাকায় প্রয়োজনীয় খেলার মাঠের দাবিতে আমরা এক হতে পারছি না। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের অভাব হলে অন্যসব উন্নয়ন যে অকার্যকর হবে সেটা আগে অনুধাবন করতে হবে।
আমার মনে হয় ঢাকা শহর উন্নয়নে সবার আগে মনোযোগ দিতে হবে অভ্যন্তরের নদী, খাল এবং পানি প্রবাহের চ্যানেল কার্যকরী করা এবং প্রয়োজনীয় খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা। যেসব নদী এবং খালের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো আদৌ পুনরুদ্ধার করা সসম্ভব কিনা সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ সেসব জায়গায় রাস্তা এবং বড় বড় ইমারত গড়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসাবে আমরা নড়াই নদীর কথা বলতে পারি। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা যে বর্তমানের পান্থপথের নীচ দিয়ে এক সময় নড়াই নদী প্রবাহিত ছিল। প্রথমে নড়াই নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মোহাম্মদপুর এবং সাত মসজিদ রাস্তা নির্মাণের সময়। আগে নড়াই নদী বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগ নদীর সাথে সংযোজিত ছিল। বিচ্ছিন্ন নড়াই নদী মৃত হয়ে যায় পান্থপথ তৈরির মাধ্যমে। এরকম অনেক নদী ও খাল উন্নয়নের নামে রাস্তায় পরিণত হয়েছে। কি ভয়াবহ আমাদের এই উন্নয়ন!
এখন উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকা শহরের ভিতর ও বাইরে দিয়ে পুনরায় পানি প্রবাহের চ্যানেল তৈরি করা। হাজার হাজার কোটি টাকার নগরায়নের চেয়ে এই উদ্যোগ অনেক বেশী প্রয়োজনীয়। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নদী, খাল ভরাটের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে তাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিতে হবে। জলাবদ্ধতা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার আগে এটাই হয়তো আমাদের শেষ সুযোগ। দখল হয়ে যাওয়া খেলার মাঠ, পার্ক এবং লেক আবার সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে নিতে হবে।
বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠন এর জন্যে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। যে উন্নয়ন জলাশয়, খেলার মাঠ দখল করে হয় সেটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলা যেতে পারে না। যে উন্নয়নে পরিবেশ দুষিত হয় সেটা উন্নয়ন না পতন।আমাদের প্রাণের ঢাকা শহর হোক আগের সেই ঢাকা। যখন প্রতিটা ঋতুর আগমন উপলব্ধি করা যেত। যখন দিনের পর দিন বৃষ্টি হলেও রাস্তা জলাবদ্ধতায় ঢেকে যেত না। যখন ছেলে মেয়েদের কোলাহলে প্রতিটা বিকাল মুখরিত থাকত। এর মধ্যেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। যদি এখনই ঢাকা শহর পুনরুদ্ধারে অগ্রসর না হই তাহলে কিন্তু এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। ঢাকার উন্নয়ন হোক নির্মলতা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে।
লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার