সূরা সাজদাহ, পর্ব ২
অনুবাদ
(৪) আল্লাহ হলেন সেই সত্তা, যিনি আসমান ও জমীন এবং উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর আরশে সমাসীন হন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবকও নেই এবং সুপারিশকারীও নেই। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (৫) তিনি আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত সবকিছু পরিচালনা করেন। অতঃপর সবকিছু (বিচারের জন্য) তারই নিকট উপস্থাপিত হবে এমন এক দিনে যার দৈর্ঘ্য হবে তোমাদের হিসাবমতে এক হাজার বছর। (৬) তিনিই অদৃশ্য ও দৃশ্যমানের জ্ঞানী। তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (৭) যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তমরূপে সৃষ্টি করেছেন এবং মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদা মাটি দিয়ে। (৮) অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। (৯) তারপর তিনি তাকে সুঠাম-সুডৌল করেছেন এবং নিজের নিকট থেকে তাতে জীবন সঞ্চার করেন। তিনি তোমাদের দিয়েছেন কান, চোখ ও হৃদয়। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
মর্ম ও শিক্ষা
ইতোপূর্বে আল্লাহর কিতাব কুরআন নাজিলের বর্ণনা ছিল, যার মাধ্যমে রাসূল (স) মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেন এবং আল্লাহর নাফরমানী সম্পর্কে সতর্ক করেন। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতসমূহে সে দাওয়াতী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে রয়েছে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদ, আল্লাহর সৃষ্টি, প্রতিপালন ও ব্যবস্থাপনা, কিয়ামত, আখিরাত ও আখিরাতের জবাবদিহিতার আলোচনা।
আল্লাহ গোটা সৃষ্টির স্রষ্টা
আল্লাহ হলেন সেই সত্তা যিনি আসমান, জমীন ও তার মধ্যে যা কিছু আছে অর্থাৎ গোটা সৃষ্টিতে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি করেছেন। গোটা সৃষ্টি জগত ও তার বাইরে এমন কেউ নেই যারা একটি জিনিসও সৃষ্টি করতে পারে। একটা তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো নেই। যিনি পৃথিবী, সৌরজগত ও মহা সৃষ্টির স্রষ্টা, তিনি আল্লাহ।
ছয় দিনে সৃষ্টির দ্বারা উদ্দেশ্য
আয়াতে ছয় দিনে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ ছয় দিনে কেনো সৃষ্টি করেছেন, অনেকে এর ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। কারণ আল্লাহ হও বললেই হয়ে যায়। নিমিষেই সব কিছু হয়ে যায়, তাহলে ছয়দিনের কিসে প্রয়োজন। আসলে এ বিষয়টি অন্য জগতের বিষয়। আমাদের পৃথিবীর জ্ঞান অনুযায়ী তা প্রকৃত কারণ জানা কঠিন। তাই কোনো ব্যাখ্যায় না গিয়ে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আল্লাহ ছয়দিনে বা সময়ের ছয়টি এককে সৃষ্টি করেছেন। এর প্রকৃত অর্থ কি তা আল্লাহই ভালো জানেন।
আরশে আরোহণের মর্ম
গোটা জগতের সৃষ্টির পর আল্লাহ আরশে সমাসীন হন। সাধারণত দুনিয়ার দৃষ্টিতে আরশ হলো রাজা বাদশাদের সিংহাসন। কিন্তু এ সিংহাসন আর সেই সিংহাসন এক না। আরশের প্রকৃত অবস্থা পার্থিব জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলেন এটি একটি নূরানী সত্ত্বা। কিন্তু এর মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ইসলামী জীবন-বিধান অনুসরণ করা আরশের অবস্থা জানার উপর নির্ভর করে না। এরপরে কথা হলো আরশে সমাসীন হওয়া প্রসঙ্গে। কোরআনে সাত জায়গায় আরশে সমাসীন হওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু তার মর্ম নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। তা কি দৈহিক নাকি রূপক, এ নিয়ে অনেক কথা আছে। কেউ কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক, তিনি সদেহে আরশে আরোহন করেছেন। আর কেউ বলেন, আল্লাহর আরশে সমাসীন হওয়া দৈহিক নয়, কারণ আল্লাহ আরশের গন্ডি ও আওতার মধ্যে সীমিত নন। এছাড়া আরশ হলো আল্লাহর সৃষ্ট, অথচ তিনি আরশের পূর্ব থেকেই আছেন। যাই হোক এ ব্যাপারে বিতর্কের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা আমাদের পার্থিব জ্ঞানের বাইরে। আমাদের শুধু বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও একক, তিনি যেভাবে যেখানে আছেন, তাতেই আমরা বিশ্বাস করি।
কিয়ামত দিবস কতটুকু দীর্ঘ হবে
আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, কিয়ামত দিবস বা হিসেবের দিন হবে দুনিয়ার হিসেবে এক হাজার বছরের সমান। কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, তা হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এ দুটির সংখ্যা দুই রকম হলেও ব্যাপারটি আসলে সাংঘর্ষিক নয়। বিভিন্ন মুফাসসির বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথম, কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ এই যে কিয়ামতের দিনের দৈর্ঘ্য হবে এক হাজার বছরের সমান, তবে কিয়ামতের দিবসটি এতো কঠিন হবে যে তা মানুষের নিকট পঞ্চাশ হাজার বছরের সমানই মনে হবে। দ্বিতীয়, কিয়ামত দিবসের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন মানুষের উপর নির্ভর করবে। যারা সৎ কর্মশীল তাদের জন্য সময় কম লাগবে। আর যারা পাপিষ্ঠ ও নাফরমান, তাদের সময় হবে অনেক বেশি।
আল্লাহ একই সঙ্গে মহাপরাক্রশালী এবং দয়ালু
আল্লাহ হলেন মহাপরাক্রশালী এবং পরম দয়ালু। যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়, যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো শরিক স্থাপন করে, যারা আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা করে এবং যারা সত্যপন্থিদের উপর নির্যাতন চালায়, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ অত্যন্ত কঠিন। তাদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে যারা মন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে চলতে চায়, আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়, কিন্তু তবুও মানবীয় দুর্বলতার কারণে তাদের বিচ্যুতি হয়ে যায়, আল্লাহ তাদের প্রতি হবেন করুণাময়। তাদেরকে করুণা করে ক্ষমা করে দিবেন। আর আল্লাহর এ দুটি গুণ দুনিয়ার বেলায়ও প্রযোজ্য। কোনো জাতি যখন সীমালঙ্ঘন করে যায়, আল্লাহ তাদেরকে ধরেন এবং পাকড়াও করেন। অনেক জাতি এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যেমন, লূত (আ)-এর জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে এবং তার ধ্বংসাবশেষ এখনও জর্ডানের মৃত সাগরে বিদ্যমান আছে। অপরদিকে যারা দুনিয়াতেও আল্লাহর পথে থাকে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাদের বিপদে সাহায্য করেন, করুণা করেন, বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই নান্দনিক
আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে গড়ে তুলেছেন। মানবদেহের অঙ্গ থেকে শুরু করে প্রকৃতির প্রাণী-পক্ষী ও সমুদ্রের জীবজন্তু-সবকিছুতেই তার নিখুঁত কুদরতের নিদর্শন ফুটে ওঠে। বাহ্যিক রূপের মতোই অভ্যন্তরীণ গঠনও বিস্ময়করভাবে সাজানো। আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন এবং মানুষের কাছ থেকে সুন্দর আচরণ ও সুন্দর ইবাদত কামনা করেন।
মানব সৃষ্টির সূচনা
আল্লাহ মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন মাটি দিয়ে। আল্লাহ আদম (আ)-কে মাটি দিয়ে তৈরী করেন। এরপর আদম সন্তানকে সৃষ্টি করেন শুক্র কণা থেকে, যা তৈরি হয় মানুষের খাবার ও রক্ত থেকে। বলাবাহুল্য, এ খাবারও মাটিতেই উৎপন্ন হয়। কাজেই প্রথম মানবের সৃষ্টি এবং পরের মানবের সৃষ্টির উৎসমূলে রয়েছে মাটি।
মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষকে সঠিক অবয়ব দান করেছেন এবং জীবন দিয়েছেন, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন সুন্দরতম অবয়বে। মানুষকে মেধা দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এ মেধা দিয়ে ছোট্ট একটা মানুষ অনেক বড় প্রাণীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। মানুষ নতুন নতুন উদ্ভাবন করতে পরে। যদিও মানুষের মেধার মধ্যে এ উদ্ভাবণী শক্তি আছে, কিন্তু তাও মানুষ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারে না। যখন যতটুকু উদ্ভাবণী শক্তি প্রয়োজন হয়, তখন আল্লাহ সে উদ্ভাবণী শক্তিকে ব্যবহারের যোগ্যতা দান করেন এবং মানুষ তা ব্যবহার করতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, সকল প্রাণীর জীবিকা আল্লাহর দায়িত্বে। এখন থেকে শতাব্দী পূর্বেও কোনো কোনো দেশ বলেছে, মানুষের প্রবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যে তাদের খাবার থাকবে না এবং মানুষ উপোষ করে মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহ মানুষের উদ্ভাবণী শক্তিকে কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার ফলে যেখানে মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে, তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এ সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য।