অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে যে রায়ের জয় হয়, তার উপরে শাসনের অধিকার বর্তায়। ৪৯ শতাংশের মত গ্রহণীয় হয় না। তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি অসস্তুষ্ট নিয়ে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত আশায় দিন কাটাতে হয়। এই সময়টাতে দেশের ভালো চিন্তার চেয়ে দলের অবস্থান, নিজেদের আখের গোছানোর পথ তালাশে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এই সাদা কথাটা সত্যি হয়ে দেখা দেয় প্রায় প্রতিটি দেশের বেলায়। বলা হয়, পক্ষ প্রতিপক্ষের সুস্থ ও গঠনমূলক সমালোচনা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যোগ্য রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক। কিন্তু এই প্রক্রিয়া যুগে যুগে জনভোগান্তি, জনবিভাজন ও অর্থ অপচয়ের পন্থা হিসেবে পরিলক্ষিত হয়ে এসেছে।
বিপরীত চিত্রও ভাবা যায়। জনগণ একটা সচেতন মানবগোষ্ঠির নাম। তাদের মতো ও পথের মূল্য আছে। রাষ্ট্রের শাসন-কাঠামো, কতৃত্বের ভার তারা তাদের হাতেই দেবেন যারা এই আমানত রক্ষার যোগ্য। নিজ ঘরের সিঁড়ি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটির পথের সংগে পরিচয় থাকবে রাষ্ট্র-কর্তার। প্রতিটি পদক্ষেপে, দৃষ্টিতে ভেসে আসবে পড়ে থাকা পাতা, ধুলোর আস্তরণ কিংবা কর্কশ কংকর। মানুষ হিসেবে নিজের ব্যথা বা একান্ত কথার মতো সবার আনন্দ বেদনার আয়নায় সাজানো থাকবে তার একান্ত ঘর। একটি আসনই তার জন্য বড় হয়ে উঠবে না, বরং চেয়ায়ের নিচের জমিনই হবে তার বিবেকের বিস্তর উপত্যকা। সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশের সেই জমিটুকু অতীব মূল্যবান আর তার ওপরের তৃণরূপ জন-প্রাণ তার কাছে অমিয়র মতো অমূল্য। তাদের লালন পালনে থাকবে পিতৃত্বের তৃপ্তি, মায়ের উজ্জ্বল চোখের মতো চির দীপ্তি।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন শাসকের দেখা মেলে বটে, তবে খুবই কম।
হৃদয়বান রাষ্ট্রনায়কের যে ছবি আমাদের মানসপটে ভাসে, তার অধিকাংশই দূর অতীতের। রাজার উপর রাজ্যভার সঁপে দিয়ে প্রজারা নিশ্চিন্তে দিন কাটাতেন। প্রাসাদ থেকে নিয়ে দূর গ্রামের ভালো-মন্দ ভালো করে জানা থাকত রাজার। দুদিন পর পর শাসক বদলাবার ঝামেলা পোহাতে হতো না প্রজাদের। আজকের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলেও মুখে মুখে রটে যেত ভালো মানুষের সুনাম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হতেন জনগণের কল্যাণের কান্ডারী। তবে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের ইতিহাস সবসময়ই সরব। ইতিহাস বইয়ের পাতা উল্টালে হাতে উঠে আসে এখনো রক্তের ছোপ। নতুন সবুজ জমিনের খোঁজ পেলে লোভী রাজার হানা থেকে বাঁচতে পারত না ছোট ছোট রাজ্যগুলো। বাইরের আক্রমণের দিকটাই বড় হয়ে দেখা যেত সেই জামানায়।
আজ জগত বদলেছে। মানুষের অধিকার সচেতনতা এখন মুখ্য বিষয়। সেই অধিকারকে সাকার করবার লক্ষ্যে রাষ্ট্রচালকের পদটি কে পাবেন তার জন্য আবিষ্কার হয়েছে গণতন্ত্র। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করা সেই ব্যক্তিত্বকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটিও যে খুব সুখকর তা বলা যায় না। নির্বাচিত হবার পর তিনিই এবং তার দলই সবকিছু এই প্রবণতা ও মানসিকতা পরিলক্ষিত হয় কাজকর্মে।
জনরায় পাবার জন্যে জনতোষামোদের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাদের চেহারা বদলে যায়। তবু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জনগণের আর কিছুই করার থাকে না। ভাবে, পরেরবার দেখে নেবে ব্যালটের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের দেখা আর হয় না। বরং তাদেরকেই দেখতে হয় দুর্দিন।
এইচিত্র, আর্থিক ও সমরশক্তিতে উন্নত দেশগুলোতেও একই। পৃথিবীর মোট ১৯৫ টি দেশের কোন্ রাষ্ট্রনায়ক তার দেশ ও সীমানার বাইরের সম্মানিত তা বলা মুশকিল। গোত্রতন্ত্রের কথা আলাদা। সেখানে ঐক্য অসম্ভব। কিন্তু একটা রাষ্ট্র যখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের বুকে থাকে অমিত বল, শক্তি ও সামর্থ্য। বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছায়া মেলে দিয়ে শীতল করতে সক্ষম দেশের সমস্ত অঞ্চল। কথা হলো, এইরকম বৃক্ষ আমরা পাব কোথায়? প্রথমত, সচেতন জনগণ প্রয়োজন, এরপরে আসে কার্যকরী সরকার কাঠামো। অভাবের দায়ে হতদরিদ্র কেউ যখন চুরিতে নামে, তার শাস্তির ব্যাপারে যেমন জনসাধারণ দারুণ সচেতন, রাষ্ট্রীয় পদে আসীন কোনো অসৎ বা দুর্জনের বেলায় কি তারা তেমন? সেজন্য, অপরাধ অনুপাতে দ্রুত বিচার শেষ করাবার পথ থাকতে হবে।
সম্প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের ব্যথিত করে বেশি করে। দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের সব বিবেকবান মানুষেরই একই অনুভব। স্বাভাবিক ভাবনা, আজ তো বৃটিশ নেই, পাকিস্তান নেই, শুধু আমরাই। একে অপরের প্রতিবেশি, পরমাত্মীয় ---- একই জনপদের মানুষ। এক উঠোনে আমাদের পাটিপেতে জোসনারাতে গল্প করবার স্মৃতি। তবু কেন এই হানাহানি!
মানুষ বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন হলেও একটি সমাজ বা দেশ যে নির্ভেজাল শান্তির হবে তা নয়। লোভ, বিদ্বেষ বা অধিক প্রাপ্তির আশা সেই বিবেকের ওপরে পর্দা ফেলে দেয়। তখন স্বার্থ প্রাপ্তিই হয়ে ওঠে প্রধান। সেই সময়, ন্যায় অন্যায় জ্ঞান হয়ে পড়ে শূন্য। সেটা যে সীমা পরিহার, তা ভাববার মতো হুঁশ আর থাকে না। এজন্য, দেশে দেশে স্কুলঘর যেমন আছে, তেমন রয়েছে জেলঘর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন বৃদ্ধি পায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে এর অঙ্গন, তার জন্য ব্যাপক, বিস্তারিত, বিশুদ্ধ ও বাস্তবে রূপায়িত পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে। তবেই, জেলখানা কমে আসবে, বাড়বে বিদ্যায়তন।
দেশের ক্ষমতায় কারা যাবে, এই চর্চা, ধ্যান-জ্ঞান এখন আকাশে বাতাসে। দুষ্কর্মের দোষারোপ দলগুলোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবাই ভাবছে,তার দলই সেরা। তার দলের সবাই ফেরেশতা। অন্যায় যত করে সব অন্যরা। এই কারণে, সত্যিকার জবাদিহিমূলক সরকার কাঠামো দরকার। কোনো নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠী বা পরিবারের কাছে দেশ যেন বন্দি হয়ে না পড়ে। তাহলে, যথেচ্ছাচার বন্ধ হতে পারে। এক্ষেত্রে আমেরিকার উদারহণ আনা যায়। যদিও ঘুরে ফিরে দুটো দলই ক্ষমতায় আসে --- হয় রিপাবলিকান নয়ত ডেমোক্র্যাট। তবু এখানে ব্যক্তি বা পরিবারের প্রভাব গৌণ। সিস্টেমই সেই প্রবণতার মানুষগুলোকে বেঁধে রাখে আঁটোসাঁটো করে। নড়াচড়া করবার সুযোগ মেলে কম। আরেকটা বিষয় হলো, কোনো দূর অজানা প্রান্তের অখ্যাত কেউ, যোগ্যতার বলে অল্পদিনেই সুখ্যাতির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে পারে। ডিবেইট বা রাজনৈতিক বিতর্কে নেমে, তিনি তার যোগত্যার স্বাক্ষর রাখতে পারেন। নিজের পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। সমস্ত দেশের মানুষ টেলিভিশনে তাকে দেখে, তার কথা শুনে, আচরণ পর্যবেক্ষণ ক’রে, তার দেশ-উন্নয়নের পরিকল্পনার তালিকা বুঝে নিয়ে তাকে ভোট দেন। বারাক ওবামা তেমন এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সোসাল অর্গানাইজার থেকে শিকাগো সিটের সেনেটর (আইনপ্রণেতা) --- এর পর প্রেসিডেন্ট। ২০০৪ সালের আগে, তাকে তেমন করে আমেরিকার মানুষ চিনতো না। সেই তিনি দুবারের প্রেডিডেন্ট হলেন।
আমাদের বাংলদেশেও এমন একটা সিস্টেমের স্বপ্ন দেখা যায়। যদিও তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা তেমন নেই। তবু মন্দের ভালো হিসেবে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা যায় তা হলো:
১. তৃণমূল পর্যায় থেকে পোড় খাওয়া, সৎ, যোগ্য, স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও দেশগড়ার অবদানে খ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে বিতর্কের ব্যবস্থা করা। নিজ নিজ এলাকায়, তাদের কথা ও পরিকল্পনা শুনে, জেনে, বুঝে তারপর জনগণ সিদ্ধান্ত নেবেন, কাকে তারা তাদের নেতা বা সমসাময়িক, যুগোপযোগি ও প্রাসঙ্গিক আইনপ্রণেতা বানাবেন।
২. দেশের যে কোনো স্থান থেকে নির্দিষ্ট বয়সের যে কেউ নিয়ম মেনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তে ফরম জমা দিতে পারবেন।
৩. রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়নের জন্য দল বা ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থীতা প্রতিযোগিতার বির্তকে অংশ নেবেন। জনগণ সবার কথা ও পরিকল্পনা বিবেচনা করে চূড়ান্ত প্রার্থিকে চূড়ান্ত নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবেন নির্দিষ্ট সময়ে জন্য। সেটা হতে পারে চার বছর, কিংবা পাঁচ বছর। কেউ দুইবারের বেশি সরকার প্রধান হতে পারবেন না।
৪. জবাবদিহিতা মূলক নিয়মে নির্বাচিত সরকার প্রধান যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন বা গড়িমসি করেন, তবে আইনপ্রণেতাগণ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার মতো সক্ষমতা রাখবেন।
৫. সরকারে থাকা অবস্থায় স্বজন-প্রীতি পরিহার, দুর্নীতিমুক্ত ও সব অবস্থায় জনগণ এবং দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। মেয়াদ শেষে, নির্বাচনের পরে নির্বাচিত জনপ্রতিধির হাতে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
তাদের একথা মনে রাখা আবশ্যক:
‘The boast of heraldry, the pomp of power,
And all that beauty, all that wealth ever gave,
Awaits alike the inevitable hour.
The paths of glory lead but to the grave.’
[Elegy: Thomas Gray]
উপলব্ধির বিষয়, ক্ষণজীবনে এমন সময় পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ ও মূল্যবান যখন কেউ ক্ষমতার মসনদে বসে। সেসময় হাওয়ার বুকে নিজের নাম লিখে যাবার সুযোগ আসে। সিদ্ধান্ত তার যে, তিনি তার নামটা ইতিহাসের স্বর্ণখচিত পাতায় লিখবেন নাকি তার নামটা আবর্জনার মতো উচ্চারিত হবে।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রবন্ধকার।
সাবেক প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিকরগাছা মহিলা কলেজ, যশোর।