বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কচ্ছপ নিয়ে কিছু মজার মজার কথা

  • সম্পাদকীয়   
  • ২৫ আগস্ট, ২০২৫ ২৩:১৩

কচ্ছপ চলাফিরায় একটি ধীরস্থির প্রাণী। আর এটিকে ঘিরে অতি প্রাচীনকালে অর্থাৎ কয়েক হাজার বছর আগেই প্রখ্যাত লেখক ঈশপ কচ্ছপ ও খরগোশের গল্পে তা তুলে ধরেছেন। যাহোক, প্রাণী জগতের মধ্যে দৈহিক কাঠামোগত দিক দিয়ে কচ্ছপ অদ্ভুত বিধায় সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। কাছিম টেস্টুডিনেস বর্গে আওতাভুক্ত। সাধারণত বাংলাদেশে ২৭ প্রজাতির কাছিম পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় হলো যে, আগে গ্রাম্য জনপদে কচ্ছপ দেখা গেলেও, এখন আর তেমন দেখা যায় না। বস্তুত কচ্ছপ হলো সরীসৃপের একটি ক্রম, যা টেস্টুডিন নামে পরিচিত। এদেরকে প্রধানত পাঁজর থেকে বিকশিত একটি শেল দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত কচ্ছপ দুটি প্রধান দলে বিভক্ত: পার্শ্ব-ঘাড়ের কচ্ছপ এবং লুকানো ঘাড়ের কচ্ছপ। মূলত এই দল দুটি মাথা ভেতরে প্রত্যাহার করার পদ্ধতিতে ভিন্ন। এদিকে বিহঙ্গ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ অন্যান্য সরীসৃপদের মতো কচ্ছপেরা বাতাসে শ্বাস নেয় এবং পানির উপরে ডিম দেয়। তবে এর অনেক প্রজাতি পানিতে বা তার চারপাশে বাস করে। আর জেনেটিক প্রমাণ অনুযায়ী সাধারণত তাদের কুমির এবং পাখির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আর কচ্ছপের খোলস বেশিরভাগই হাড় দিয়ে তৈরি। উপরের অংশটি গম্বুজযুক্ত ক্যারাপেস এবং নীচের অংশটি ফ্ল্যাটার প্লাস্ট্রন বা বেলি-প্লেট। মজার ব্যাপার হলো যে, এদের বাইরের পৃষ্ঠ কেরাটিন, চুল, শিং এবং নখর উপাদান দিয়ে তৈরি আঁশ দিয়ে আবৃত এবং ক্যারাপেস হাড়গুলি পাঁজর থেকে বিকশিত হয়, যা পাশের দিকে বৃদ্ধি পায় এবং চওড়া সমতল প্লেটে বিকশিত হয়। এই চওড়া সমতল প্লেট শরীরকে ঢেকে দেয়। কচ্ছপ হলো ইক্টোথার্ম বা ‘ঠাণ্ডা রক্তযুক্ত’, যার অর্থ তাদের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এরা সাধারণত সর্বভুক।

সাগর কিংবা নদীর তীর, এমনকি অনেকসময় পুকুর, জলাশয় ইত্যাদিতে মাথা তুলে রাখা অবস্থায় দেখা মেলে। আবার মাঝে মধ্যে ডাঙাতেও দেখা যায়। সাধারণ মানুষের ভাষায় এরা সবই কচ্ছপ বা কাছিম বলে পরিচিত হলেও, বই-পুস্তকের ভাষাতে যারা পানিতে বাস করে তাদেরকে কাছিম, স্থলে বাস করলে কচ্ছপ এবং যারা ঈষৎ লবণাক্ত পানিতে বাস করে তাদের টেরাপিন বলে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কাছিম ও কচ্ছপের বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। কচ্ছপ ও কাছিম দুটি ভিন্ন প্রাণী, যা চোখে দেখেই সহজে আলাদা করা যায়। পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে, কচ্ছপ স্থলজ প্রানী, জীবনের বেশির ভাগ সময় স্থলে কাটায়। তৃষ্ণা পেলে কেবল পানির সংস্পর্শে আসে। অন্যদিকে কাছিম জলজ প্রাণী। আর কচ্ছপ স্থলে থাকার কারণে এর পিঠে শক্ত গোলাকার খোলস থাকে। নিজেদের আত্মরক্ষার্থে এটি তাদের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু কাছিমের পিঠে খুব একটা শক্ত খোলস থাকে না বিধায় পাতলা খোলসের কারণে তারা অনায়াসে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। এদিকে বেশির ভাগ কচ্ছপই তৃণভোজী হয়ে থাকে। অন্যদিকে কাছিম সর্বভুক; মাছ, মাংস, ফলমূল, সবজি, কোনো কিছুতেই এদের ‘না’ নেই। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী প্রজাতি ছাড়া কচ্ছপ সাধারণত কয়েক সেন্টিমিটার থেকে দুই মিটার পর্যন্ত বড় হয়। দিবাচর প্রাণী হিসেবে কচ্ছপ পরিচিত। তবে দলবদ্ধ হয়ে জীবনযাপনে খুব একটা অভ্যস্ত না। জীবনকালের দিক থেকে কচ্ছপ কাছিমের চেয়ে অনেক বেশি বছর বেঁচে থাকে। কচ্ছপ সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ বছর বাঁচে, কিছু ক্ষেত্রে শত বছরও পার হয়ে যায়। সে তুলনায় কাছিমের জীবনকাল অনেক কম, মাত্র ২০ থেকে ৪০ বছর। আর কাছিমের পায়ের আঙ্গুলগুলোর মাঝে বুনট চামড়ার জাল থাকে। কিন্তু কচ্ছপের এ রকম থাকে না, যার কারণে কচ্ছপ মাটিতে হাঁটতে পারলেও কাছিম পারেনা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ২৩ মে ‘বিশ্ব কাছিম দিবস’ হিসাবে পরিচিত। মূলত জীববৈচিত্র বজায় রাখার গুরুত্ব ও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণেই ২০০০ সালে ‘অ্যামেরিকান কচ্ছপ উদ্ধার’ নামক প্রতিষ্ঠান এই দিবসের সূচনা করেন। তখন থেকেই সারা পৃথিবীজুড়ে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর প্রায় সকল সমুদ্রেই এদের বিচরণ রয়েছে এবং এরা বাসা বানানোর জন্য সাধারণত তুলনামূলক উষ্ম অঞ্চল পছন্দ করে। খাবার গ্রহণ, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মিলন থেকে শুরু করে সকল আনুষঙ্গিক কাজই সাগরে করলেও ডিম পাড়ার সময়ে স্ত্রী কাছিমকে দ্বীপে আসতেই হয়। এরা ডিম পাড়ার সময়ে খুব নির্জন স্থান বেছে নেয় এবং যদি সেখানে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ডিম পাড়া বন্ধ করে মা কাছিম আবার সাগরে ফেরত চলে যায়। কচ্ছপদের অনেক প্রজাতির নারী ও পুরুষ আলাদা। কিছু প্রজাতির পুরুষদের ঘাড় মেয়েদের থেকে লম্বা থাকে। আবার কিছু প্রজাতির মেয়েদের নখ পুরুষদের থেকে বড় হয়ে থাকে। অধিকাংশ কচ্ছপ প্রজাতিতে পুরুষদের থেকে মেয়েরা আকারে বড় হয়ে থাকে। পুরুষের খোলসের উপরের অংশ প্রজননে সুবিধার জন্য ভেতরের দিকে বাঁকানো থাকে। কচ্ছপদের লিঙ্গ নিরূপণের সব থেকে সহজ উপায় হলো তাদের লেজ প্রত্যক্ষ করা। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, সাধারণত মেয়েদের নিচের দিকে বাঁকানো ছোট লেজ থাকে। অন্যদিকে পুরুষদের উপর দিকে বাঁকানো তুলনামূলকভাবে বড় লেজ থাকে। আর বড় কচ্ছপরা শুকনো জমিতে খুব ধীরে চলে, প্রায় ০.২৭ কিমি./ঘণ্টা। পূর্বেই কিছুটা উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ ডাঙ্গায় বসবাসকারী কচ্ছপ তৃণভোজী। এরা সাধারণত ঘাস, আগাছা, পাতা, ফুল এবং ফল খেয়ে বেঁচে থাকে। অবশ্য কিছু সর্বভূক কচ্ছপও আছে। কিছু প্রজাতি তাদের বাসস্থানে প্রাপ্ত কীটপতঙ্গ এবং মৃতদেহও খেয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, তৃণভোজী কচ্ছপদের অতিরিক্ত আমিষ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কেননা খোলস বিকৃতিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে। সেহেতু প্রত্যেক প্রজাতির কচ্ছপের পুষ্টির চাহিদা ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সনাতনী ধর্মে কচ্ছপ নিয়ে মজার কাহিনী আছে। এ ব্যাপারে উল্লেখ্য যে, কূর্ম অবতার ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার। মৎস্য অবতারের মত কূর্ম অবতারও সত্য যুগের। ভগবান বিষ্ণু শরীরের উপরের অংশ মানুষের এবং নিচের অংশ কচ্ছপের রূপ ধারণ করেন। তাকে প্রথাগতভাবেই চতুর্ভুজ রূপে দেখা যায়। তিনি মহাপ্রলয়ের পর সাগরের নিচে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকেন। সমুদ্র মন্থনের সময় তার পিঠে মন্দার পর্বত স্থাপন করে মন্থনের কাজ সম্পন্ন হয়। এদিকে প্রাচীন চীনে কচ্ছপের খোলস ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যবহার করা হতো। আর প্রাচীন গ্রিক দেবতা হার্মিস এর প্রতীকও কচ্ছপ। কচ্ছপের খোলসের উপরের অংশে যে সমকেন্দ্র বিশিষ্ট বিং থাকে, তা তাদের বয়সের একটি ধারণা দিয়ে থাকে; যেমনটি গাছের ক্ষেত্রে বর্ষবলয়ে দেখা যায়। কিছু কিছু কচ্ছপের ১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচার কথা শোনা যায়। বস্তুত দীর্ঘ আয়ুর বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, স্তন্যপায়ী প্রাণীতে ক্যান্সারের হার গড়ে ১০ শতাংশ। পাখীদের হার প্রায় ৩ শতাংশ। অথচ এদের ক্যান্সারের হার ধারাবাহিকভাবে ১ শতাংশেরও নিচে। তাছাড়া কচ্ছপের বিপাক ক্রিয়া ধীর এবং রোগসৃষ্টির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান।

পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ভরাট, ঝোপ-ঝাড় বিনষ্ট, পানি দূষণ, খাদ্যাভাব ও মানুষের আক্রমণে পরিবেশের বন্ধু কচ্ছপ হারিয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর ২৭০ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে প্রায় ১শ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অবৈধ শিকার, বাণিজ্য ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের কাছিম ও কচ্ছপের সব প্রজাতিই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, সাতক্ষীরা, খুলনা, মাদারিপুর ও গোপালগঞ্জেও কাছিম ও কচ্ছপ বেচা কেনা ও খাওয়ার আধিক্য দেখা হয়। সাধারণত অমুসলিমরা এর মাংস খেয়ে থাকে। অবশ্য বর্তমানে প্রকৃতির বন্ধু এই প্রাণী রক্ষায় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ‘পরিবেশ বন্ধু কাছিম, প্রকৃতিতে বাঁচতে দিন’ স্লোগানের আওতায় শুরু হয়েছে ক্যাম্পেইন। এটি সত্য যে, নদী-পুকুরের পানি পরিস্কারের ব্যাপারো কচ্ছপ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি এই মর্মে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, বিপন্ন এই কচ্ছপ যাতে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকে যার যার মতো করে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এ বিশ্বে কোনো জীবই এমনি আসেনি। এর পেছনে তাদের প্রয়োজনীয়তা আছে। কেননা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে এদের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। জলাশয়ে বা নদীতে কাছিম থাকলে এর পানি পরিস্কার থাকে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় থাকে। আর সেই নদী বা জলাসয়ের সার্বিক অবস্থা ভালো থাকে। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে কাছিম নদীর তলদেশের পঁচা আবর্জনা খায়, যা পানিকে দূষিত হওয়া থেকে বাঁচায়। এতদ্ব্যতীত কাছিম নদীর তলদেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্য সরবরাহ সহায়তা করে থাকে। আর সনাতনী ধর্ম মতে কচ্ছপ সৌভাগ্য, সমৃদ্ধ, সম্পদ এবং শান্তি আকর্ষণ করতে সহায়তা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

লেখক : গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর