পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান চেয়েও অনেক সূচকেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অতি দারিদ্র পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র্য হার কমেছে। এই প্রবণতাকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবে মনে করা হয়। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগন। এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারনে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য অনেকটাই কমে আসছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমার প্রধান কারন, এদেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ একসময় দারিদ্রের করালগ্রাসে নিমজ্জিত ছিল, একথা সত্যি। তবে তখন নানা প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক দ্বিধাবিভক্তি, দায়সারা মনোভাব, নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডের অশুভ তৎপরতা প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থা নেই। ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নতুন নতুন অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। দেশ ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানান আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. আগের অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলÑখোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং জনগণ তাতে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এ গুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। তাই এখন একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি গিয়ে পড়ে সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরে। গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে বেসামাল অর্থনীতিকে অনেকটা লাইনে আনা গেলেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়েছেন অনেক মানুষ। সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় কৃষকেরা একের পর এক ফসলে লোকসান গুনছেন। ঋণগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা এই আর্থসামাজিক বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর পবায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা এবং মোহনপুরে পানচাষির আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কেননা এ দুটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফসলে ন্যায্য দাম না পেয়ে ও ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো নাগরিকের অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের দিক থেকে যে ধরনের জোরালো উদ্যোগ থাকা দরকার, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। ১৬ আগস্ট পবা উপজেলার বামনশিখর গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা মরে গেলাম।’ অন্যদিকে মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে ১৮ আগস্ট আকবর হোসেন নামের এক কৃষক ঋণের চাপ ও পান চাষে লোকসানের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা দেখছি যে দুটি ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য আর ঋণের চাপ আত্মহত্যা ও স্বজন হত্যার মতো মর্মান্তিক পথ বেছে নেওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মিনারুল অভাব লুকিয়ে রাখতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত তাকে এমন ভয়াবহ পথে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে আকবর প্রমাণ করলেন, আমাদের কৃষকদের এখনো কতটা অনিশ্চয়তা ও সুবিধাহীনতার মধ্যে বাস করতে হয়। একদিকে তিনি ১৩টি এনজিওর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, অন্যদিকে পান চাষ করে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষকেরা কেন তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন না। কৃষকদের সুরক্ষা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি। এ ভূমির কৃষক–প্রজাদের দীর্ঘ লড়াইয়ে কয়েক দশক আগে যে মহাজনি প্রথার উচ্ছেদ হয়েছিল, সে ব্যবস্থা কেন আবার নতুন করে ফিরে আসবে? কৃষকেরা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারেন, সে সংস্কার করাটাও জরুরি। সরকারকে অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। সরকারকে অবশ্যই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বাজারের হাল দেখে এটিই স্পষ্ট হয় যে বাজারের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণিপেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেই দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সরবরাহ চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এই অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।