বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ যা আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বৃহৎ অর্থনীতি। ২০২৪ সালের হিসাবের ভিত্তিতে দেশের মোট জিডিপির আকার ৪৫০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৫৪ বছর বয়সের বাংলাদেশ এখনো অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে পারেনি। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ও ঘাটতি বাজেট পূরনের জন্য ও দেশটিকে বৈদেশিক সাহায্যদাতা সংন্থার উপর নির্ভরশীল হতে হয় যা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। সরকারের বাজেট ঘাটতি প্রায় উন্নয়ন বাজেটের সমান এবং অর্থ অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠেনা। কোনো বছরেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়না। যেমন ২০২৪-২৫ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, অর্জন হয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা ও ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আরও উল্লেখ্য যে কর জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ার সকলের নিচে অবস্থান করছে। অর্থ মন্ত্রনালয়ের তথ্যমতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের দেশি বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঋণের পরিমান উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। সরকারের ঋণের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক, বিমা, ট্রেজারি বন্ড, সেভিং বন্ড, প্রাইস বন্ড ইত্যাদি। প্রতি বছর সরকার রাজস্ব টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। করের ফাঁকির পরিমাণ বেড়েছে, কর এলাকার প্রসার সঙ্কুচিত হয়েছে, পরোক্ষ করের উপর নির্রশীলতা বাড়ছে ইত্যাদি।
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা যায় যে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৩০ বিলিয়ন টাকা এবং বাংলাদেশ অনিবন্ধিত ৬ লাখ বিদেশি কর্মী কর ফাঁকি দিয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকার উপরে যা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র দুর্বল কর কাঠামো ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে। বিগত কয়েক বছরে ব্যাংকের উপর ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে। যেমন ২০২২ সালের শেষ থেকে ২০২৪ ডিসেম্বর পযর্ন্ত ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৩,০৯,৮৮৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে এই আমানতের ৮৭% সরকার ঋণ হিসাবে নিয়েছে এবং বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। এখন প্রশ্ন হলো সরকার কেন এত বেশি ঋণ নেয় এবং কেনই সুদে-আসলে তা পরিশোধ করতে হয়। একজন উপদেষ্টা বলেছেন সরকার ঋণ নেয় বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য। ইআরডির তথ্য বলছে ২০২৪-২০২৫ বৈদেশিক ঋণের ৬৮% ব্যয় হয়েছে পূর্বের বকেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেছেন ২০২৫-২৬ বছরের বাজেট হবে ঋণের দুষ্ঠু চক্র ভাঙার বাজেট। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের বিষয়ে ২০২৪-২৫ সময়ে প্রথম ৮ মাসে ৪১টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং আই,এম,এফ/বিশ্বব্যাংক এর কাছে অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে যা দুঃখজনকও বটে। রিজার্ভ বাড়াতে হবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে তাহলেই এটি টিকসই হবে। বিভিন্ন মাধ্যম বলছে বাংলাদেশে প্রকল্প ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বেশি যার কারণ রাজনৈতিক বিশেষত: দ্বীপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চীন ও রাশীয়ার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়টি। এখন সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুকি হলো এই সকল ঋণের পরিশোধ। ই,আর,ডি বলছে ২০২৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদশিক ঋণ নিয়েছে তার জন্য ২০২৯ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসল পরিশোধ করতে হবে। বিগত সরকার যত ঋণ নিয়েছে সবই বিতর্কিত ঋণের মধ্যে পড়ে যায় একটা মৌকুফের সুযোগ থাকতে পারে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৩.৬২ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে সরকার দেশি ও বৈদেশিক উৎসের ঋণের ওপর অধিক নির্ভর করছে। বাজেট ঘাটতির বড় একটি অংশ, প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া হবে। বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। চলতি অর্থবছরের ২১ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা, যেখানে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রির গতি কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ ছাড় কমে যাওয়াই এর পেছনে অন্যতম কারণ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা মূল বাজেট থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি ব্যয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা।
আবার রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়াতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ হাতে নেওয়া হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ নামের একটি নতুন প্রকল্প। এটির মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৮ কোটি ৮০ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে এক হাজার কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এই ঋণ পাওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এদিকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি নিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের পাবলিক রিলেশন বিভাগের প্রধান জানান, ১২ জুন সরকারি খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতা বাড়াতে ২৫ কোটি ডলারের একটি ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক বোর্ড। সেই ঋণের মধ্যে রাজস্ব বোর্ড সংস্কারসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে ঋণ রয়েছে। তবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঋণ চুক্তি কবে নাগাদ হতে পারে সেটি ইআরডি বলতে পারবে। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বাংলাদেশের রাজস্ব সংগ্রহ অত্যন্ত কম, যা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। দেশে রাজস্ব ও জিডিপির অনুপাত ২০১২ অর্থবছরে ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যেটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। এই সময়ের মধ্যে কর জিডিপির অনুপাত ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে স্থবির হয়ে পড়ে। সর্বশেষ গত বছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। এটি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমকক্ষ দেশগুলোর অনুপাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্য কম। এ পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের চিহ্নিত করা তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো- প্রথমত, বাণিজ্য সম্পর্কিত করের ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা। দ্বিতীয়ত, একটি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থা থাকলেও সেটি অসংখ্য ছাড় এবং সংক্ষিপ্ত হার দিয়ে চিহ্নিত। যেটি দারিদ্র্যবান্ধব না হলেও রাজস্ব আদায় বাড়াতে কাজে আসছে না। তৃতীয়ত, আয়করের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাড়, কর্তন এবং অবকাশ সুবিধা দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হলেও রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং সুনির্দিষ্ট নীতি সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় রাজস্ব আদায় কাঙ্খিত পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্পে যেসব সংস্কার নিশ্চিত করা হবে সেগুলো হলো-জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট বিজনেস প্রসেস প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পরিবর্তন এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ। এছাড়া প্রশিক্ষণ, বিশ্লেষণী ও নীতি বিশ্লেষণ সক্ষমতা জোরদারকরণ, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং একটি শক্তিশালী গবেষণা ও পরিসংখ্যান ইউনিট প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি সংস্থাটির সেবা প্রদান ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য তৈরি মাস্টার প্ল্যান বিশ্লেষণ, পরিবর্তন এবং সে অনুসারে স্বয়ংক্রিয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। আরও আছে, আয়কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে সহজ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়করণ, বিদ্যমান ও নতুন সিস্টেমগুলোর মধ্যে কার্যকর আন্তঃসংযোগ স্থাপন এবং নতুন সিস্টেম প্রবর্তন। এনবিআর সংস্কারের কার্যক্রম হিসাবে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর উভয় ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার তৈরি করা হবে। এছাড়া এনবিআরের বিদ্যমান ও প্রস্তাবিত সিস্টেম যেমন এ্যাসাইকোডা ওয়ার্ল্ড, আইভিএএস এবং আয়কর সংক্রান্ত অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে আইবিএ এসপ্লাস প্লাস ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডেটা প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করা হবে। করদাতাদের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। রাজস্ব বোর্ডের জনবল, কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি আধুনিক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি। কর প্রশাসনের জনবলের দক্ষতা বাড়াতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। একটি পূর্ণাঙ্গ আয়কর প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য সমীক্ষা ও নকশা তৈরি করা হবে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য।