বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দুর্বোধ্য দুর্নীতি

  • সম্পাদকীয়   
  • ২০ আগস্ট, ২০২৫ ০১:২৪

আমাদের দেশের বহুল আলোচিত কিছু শব্দের মধ্যে ‘দুর্নীতি’ অন্যতম। কম বেশি সবাই এ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে থাকে। আলোচনার সময় মনে হয় সবাই দুর্নীতিকে অপছন্দ তো করেই; অনেকে তীব্র ঘৃণাও করে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, যারা ক্ষমতায় থাকে না তারাও বলে, সাধারণ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে, নাটক-সিনেমা, গল্প সবজায়গায় যে যেভাবে পারছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। দৃশ্যত সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকলেও এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দুর্নীতি আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে একটা কেন? কোনোভাবেই কেন দুর্নীতির মোহ এবং গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারছে না?

আমাদের কাছে এই দুর্নীতি আসলে একটা দুর্বোধ্য বিষয়। অনেকে হয়তো ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা? দুর্নীতি তো দুর্নীতিই। এটা দুর্বোধ্য হওয়ার কি আছে। কেন এটা দুর্বোধ্য সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের চোখেই দুর্নীতির কথা বললে সরকারি অফিসে স্তূপ করে রাখা কিছু ফাইলের কথা মনে পড়ে যায়। অর্থাৎ দুর্নীতি হচ্ছে টাকার বিনিময়ে কিছু ফাইলের ফলপ্রসূ আদান প্রদান। টাকার বিনময়ে বিভন্ন সিদ্ধান্ত বা কাজ পাওয়া অবশ্যই দুর্নীতি তবে এটাই দুর্নীতির মূলকথা না। দুর্নীতি এরচেয়েও অনেক ব্যপক বিষয়। দুর্নীতির সহজ ও মিনিংফুল সংজ্ঞা হচ্ছে, অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যাক্তিগত লাভের জন্যে অনৈতিক ও অবৈধ কাজ করা। এই সংজ্ঞায় একটা ছোট দুর্বলতা রয়ে গেছে। এখানে বলা হয়েছে কেউ যদি অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে। অর্থাৎ, দুর্নীতি করতে হলে ক্ষমতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি মানে অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করা। কেউ যদি অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করতে সহযোগিতা করে তাহলে সংজ্ঞা অনুযায়ী সরাসরি তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাচ্ছে না। আর এই সুযোগটাই আমরা হর হামেশা নিয়ে যাচ্ছি।

আমি তখন সবে এইচ এস সি পাস করে একটা স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস করা শুরু করেছি। ঢাকা ইউভার্সিটির পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি পরীক্ষা দেব বলে সিদ্ধান্ত নেই। তবে দুটো সাবজেক্ট ছাড়া আর কিছুতে ভর্তি হতে মন চাইছিল না। বিবিএ এবং ইংলিশ লিটেরেচার। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে নির্ধারিত দুই দিনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। গাবতলি থেকে বাসের ছাদে করে যাতায়াতের সময় আমার এক সহপাঠীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বেশ সখ্যতার জন্ম নেয়। প্রথম দিন বিবিএ ভর্তি পরীক্ষা ছিল। পরের পরীক্ষা ইংলিশ। বেশ কঠিন প্রশ্ন এসেছিল। পরীক্ষা হলে প্রশ্ন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে ইংলিশ লিটেরেচারের প্রশ্ন যত কঠিন হবে আমার চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে। যাই হোক পরীক্ষা দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হলাম। আমার সেই নব্য বন্ধুর সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে পরীক্ষা কেমন হয়েছে। দেখলাম ও ‘ভালো’ বলে মিটিমিটি হাসছে। দুজনে আবার বাসের ছাদে উঠলাম। দুটো পরীক্ষাই আমার দারুণ হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম আসন মাত্র আশিটা (যতদূর মনে পড়ে) তাতে কি আমার পজিশন দুটোতেই দশের মধ্যে থাকবে। হঠাৎ আমার সেই নব্য বন্ধু হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল ‘সব কমন পড়েছে না?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ভর্তি প্রশ্ন আবার কমন পড়ার কি আছে? আমার প্রিপারেশন ভালো ছিল। দারুণ পরীক্ষা দিয়েছি’। ও তখন বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। ‘মঙ্গলবারে যে প্রশ্ন আউট হয়েছিল সেটা তুমি পাউনি? ইংলিশ, বিবিএ দুইটার প্রশ্নই তো আউট হয়েছে।’ আমার মাথায় মনে হলো বাজ পড়ে গেছে। পরে জানলাম প্রতি প্রশ্ন পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। হুবহু সেই প্রশ্নগুলোই এসেছে। রেজাল্ট বের হলে দেখলাম আমার সেই নব্য বন্ধু ভর্তি হচ্ছে আর আমার নাম ওয়েটিং লিস্টের বার নম্বরে। এখনো সেই অনুভূতি আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। আমার মেধা, আমার শ্রম কিভাবে অপমানিত হয়েছিল সেটা অগ্রহণযোগ্য। এভাবে আমাদের দেশে এ পর্যন্ত আমার ধারণা লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ হয় প্রশ্ন আউটের সুযোগ নিয়ে বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থা বা সুপারিশের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছে বা চাকরি পেয়েছে। তারা কি আসলেই মন থেকে দুর্নীতিকে ঘৃণা করে?

আমি এমন অনেক ক্ষমতাশালী সৎ মানুষ দেখেছি যারা ঘুষ খায় না। টাকা পয়সার বিষয়ে খুবই স্বচ্ছ; কিন্তু সুপারিশের মাধ্যমে নিজের কাছের মানুষদের আর্থিক বা অন্য কাজ পাইয়ে বড় ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে। অযোগ্য কাউকে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কোটিপতি করে দিচ্ছে। আর্থিক লেনদেন না করলেও সেই ক্ষমতাধর ব্যাক্তিকে আপনি কি দুর্নীতিগ্রস্ত না বলে থাকতে পারবেন? সুপারিশ খুব পরিচিত একটা শব্দ। চাকরির ক্ষেত্রে, সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে, কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে, কিছু সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মের বাইরে আমরা প্রতিনিয়ত অমুক নাহলে তমুকের কাছে ধরনা দিচ্ছি। আমি যখন নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো সুবিধা পাচ্ছি সেটাই কিন্তু অনিয়ম এবং দুর্নীতি। যেখানে আমাদের অনেকেই প্রতিনিয়তই ক্ষমতাধর কারো সুপারিশ নিয়ে হাজির হচ্ছি সেখানে দুর্নীতিকে আসলেই কি আমরা মন থেকে ঘৃণা করতে পারছি?

আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার সময় খুব সোচ্চার; কিন্তু অনেকে সুযোগ পেলেই দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা নিতে প্রস্তুত। এই মানসিকতাই আমাদের সমাজে দুর্নীতির টিকে থাকার মূল গল্প। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেসব কারণে আমাদের ভেতরে দুর্নীতি শক্তিশালী অবস্থান গেঁড়ে আছে। মানুষ আপনার সফলতা দেখতে চায়। আপনি কিভাবে সফল হলেন সেটা মুখ্য না। সফলতা অর্জনে কোনো এক পর্যায়ে অসৎ হয়েছিলেন কিনা সেটা অনেকের কাছে কোনো বিষয়ই না। এর জন্যেই যেকোনোভাবে আমরা সফল হতে চাই। যে ব্যক্তি অনিয়মের মাধ্যমে সফল হচ্ছে সে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।

দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্যে আমাদের দেশের সিস্টেম অনেকাংশে দায়ী। যেহেতু আমাদের দেশের অনেকেই দুর্নীতিতে আসক্ত তাই কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পেলেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া কেউ যদি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে চায় তাহলে সে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে যায়। একটা দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে অসৎ মানুষেরা যত সহজে সবাই এক হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে সৎ মানুষেরা কিন্তু তত সহজে এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ সৎ মানুষেরা একটু নন কম্প্রোমাইজিং হয়। এর কারণে কর্মক্ষেত্রে একজন অসৎ মানুষ তার অসৎ বসের কাছ থেকে চাকরিতে যে সুবিধা পেয়ে থাকে একজন সৎ মানুষ তার সৎ বসের কাছ থেকে ঠিক একই ধরণের চাকরি সংক্রান্ত সুবিধা পায় না। এ কারণেই অসৎ মানুষেরা কোনো একটা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থায় অনেক সংগঠিত হয়ে অসৎ কাজ করে যেতে থাকে।

আমরা যতই বলি না কেন দুর্নীতি আমাদের দেশ থেকে সহজে যাবে না। আমাদের মন মানসিকতায় এক ভয়াবহ বিকৃতি ঘটেছে। আমরা ক্ষমতা চাই ক্ষমতা অপব্যবহার করার জন্যে, ক্ষমতা দিয়ে ভুলকে ঠিক করার জন্যে না।হয়তো কেউ কেউ ক্ষমতাকে অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিয়ে ভালো কাজ করে যাচ্ছেন তবে সে সংখ্যাটা খুবই কম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না তুললে কোন ফল পাওয়া যাবে না। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সরকারিভাবেও কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতি বছর ভালো কাজের জন্যে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষকে কখনো তিরস্কার করতে দেখি নাই। প্রতি বছর দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের লিস্ট করে জনসম্মুখে আনতে হবে। তাহলে দেখবেন তারা সামাজিকভাবে লজ্জায় পড়বে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করা হয় না। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় সফল মানুষদের নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। অথচ সবচেয়ে বেশি প্রতিবেদন দরকার সৎ মানুষ এবং অসৎ মানুষদের নিয়ে। একজন সৎ মানুষকে শুধুমাত্র সততার ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি কাউকে স্বীকৃতি দিতে দেখিনি। সৎ এবং অসৎ এই ধরনর মানুষকেই সমাজে পরিচিত করিয়ে দিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে অসৎ মানুষদের কোরাম এত বেশি শক্তিশালী যে তাদের স্পর্শ করা সম্ভব না। তারচেয়ে বড় কথা আমরা রিয়েক্ট করি শুধু ভাইরাল হওয়া দুর্নীতিতে। অন্যসব দুর্নীতিতে চোখ বন্ধ করে না দেখার ভাণ করে থাকি। কারণ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা মনে প্রাণে দুর্নীতিকে ঘৃণা করি না বরং বুঝে না বুঝে দুর্নীতি করার সুযোগ খুঁজতে থাকি।

লেখক: কথাশিল্পী ও নাট্যকার

এ বিভাগের আরো খবর