একটি নগরী কতটা সভ্য, তা মাপার অন্যতম একটা মানদণ্ড হলো তার যাতায়াত ব্যবস্থা। আর যাতায়াতকে যদি মানদণ্ডে রাখা হয় তবে সিলেট মহানগর নিঃসন্দেহে বিশ্বের ইতরতম নগরগুলোর মধ্যেই পড়বে। শব্দচয়নটি যদিও একটু অশালীন হয়ে গেল, কিন্তু প্রতিদিন সিলেটের রাজপথে নাগরিকদের যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তার তুলনায় এটা যথেষ্ট কম।
বিগত তিন বছরে সিলেট নগরে চলাচল এতটাই কঠিন হয়ে উঠেছে যে, সড়কে চলাচল এখন নির্জলা ভোগান্তির প্রতিশব্দে রূপ নিয়েছে। যদিও সিলেটে সড়ক দখল বা ফুটপাথ বাণিজ্য বহু পুরানো সংকট, কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে তা আকস্মিকভাবে বেড়েছে বহুগুণ।
অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য হলো, এই মুহূর্তে সিলেটের রাস্তায় যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে নির্ধারিত কোনো ভাড়াই নির্ধারণ করা নেই। অথচ একটি শহরে শান্তিপূর্ণ, ভোগান্তিহীন যাতায়াতের প্রথম শর্তই হচ্ছে সুনির্দিষ্ট ভাড়া, যা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য রাখার নিশ্চয়তা দেয়ার কথা সড়ক ও নগর কর্তৃপক্ষের।
সিলেট নগরের মূল যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। অল্প কিছু সরকারি টাউনবাস ব্যতীত গণপরিবহনে আর কোনো মাত্রা নেই এখানে। বাস কর্তৃপক্ষের ভাষ্যানুসারে, সিএনজি চালকরা বাস চলাচলে বাধা দেন বিধায় নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। আবার আয়তনের কারণে নগরের সব দূরত্বে রিকশা দিয়ে যাতায়াত অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয়। এমতাবস্থায় সিলেটের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের যাতায়াতের মূল মাধ্যম হয়ে উঠেছে সিএনজি। এ কারণে গত কয়েক বছরে নগরে সিএনজির সংখ্যাও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।
এতে বহু যুবক-তরুণের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হলেও সিএনজিতে ভাড়ার বিষয়টি একেবারেই লাগাম ছাড়া।
বছর দুই আগেও সিলেটে এক স্ট্যান্ড থেকে আরেক স্ট্যান্ডে গড়পড়তা ভাড়া ছিল দশ টাকা। বেশি দূরত্বে তা পনেরো টাকা পর্যন্ত নিতের চালকরা। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে সিলেট নগরীতে চলাচলকারী সিএনজিতে যাত্রী বহন বিষয়ক আইনের বাস্তবায়ন ও লোহার গেট বসানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ব্যাপারটা মূলত এই যে, পেছনে সর্বোচ্চ তিনজন এবং সামনে চালক ব্যতীত অপর কোনো যাত্রী পরিবহন না করার নির্দেশ সিএনজির রুট পারমিটে শুরু থেকেই আইনত বিদ্যমান। রাজধানী ঢাকায় যেমনটা দেখা যায়। কিন্তু সিলেট নগরীতে পরিস্থিতি, প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় এই আইন কাগজে ফাইলবন্দি হয়েই রয়ে গেছে।
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকায় যাতায়াতের মূল মাধ্যম বাস, যা একসঙ্গে অনেক যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। সিলেট একটি মহানগর হওয়া সত্ত্বেও এখানে অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে বাসের ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত। যে কারণে এখানে সিএনজিতে যাত্রী সংখ্যায় বিধিনিষেধ চাপানো হলে তাতে শুধু যাত্রী ভোগান্তিই হবে। আবার পাঁচজনের পরিবর্তে তিনজন নিয়ে সিএনজি চালালে, ভাড়াও গুণতে হবে আরও বেশি। হয়েছিলও এমনটি।
এক সময় সিএনজিতে যাত্রী বহনে পাঁচের পরিবর্তে তিন যাত্রী বহনের বাধ্যবাধকতা আরোপের চেষ্টা চলছিল। সেসময় চালকরা নিজ থেকেই তিন যাত্রী বহন শুরু করেন এবং এর বিনিময়ে যাত্রীপ্রতি চলমান ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় শুরু করেন। তখন তাদের যুক্তি ছিল, পূর্বে পাঁচ যাত্রীতে দশ টাকা করে পঞ্চাশ টাকা পেতেন, এখন তিন যাত্রী থেকে ১৫ টাকা করে নিলেও তাদের পাঁচ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাত্রীদেরও পাঁচ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছিল। কিন্তু চালকদের অপপ্রচারে ক্ষোভটা এককভাবে কর্তৃপক্ষের ওপরই পড়ছিল। এমতাবস্থায় সে সময় চালকদের কাছে জিম্মি হওয়া ছাড়া নাগরিকদের দ্বিতীয় পথ ছিল না।
অনেক সময় ‘যাত্রী কম’ অজুহাতে দশ টাকার ভাড়া পনেরো টাকায় তোলেন চালকরা। আবার স্ট্যান্ড টু স্ট্যাণ্ড দূরত্বে যাত্রীপ্রতি ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকেন তারা। যেমন সিলেটে বন্দর থেকে টিলাগড় পর্যন্ত আগে থেকেই ভাড়া ছিল দশ টাকা। এটাকে এক সময় ‘কম যাত্রী’র অজুহাতে পনেরো টাকা বানিয়ে নেয়া হয়। পরে বর্তমানে সেটি হয়েছে বিশ টাকা। এ ক্ষেত্রে চালকদের মন্তব্য- বিশ টাকাই লাগবে। যেতে চাইলে চলুন, নাহলে বাদ দিন।
এমনকি একই দূরত্বে একই সঙ্গে ওঠা আলাদা আলাদা যাত্রীর কাছ থেকে দুইরকম ভাড়া নেয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। নগরের টিলাগড়-আম্বরখানা, বন্দর-আম্বরখানা, বন্দর-দক্ষিণ সুরমাসহ সব স্ট্যান্ডেই এক চিত্র। প্রতিবাদ করতে গেলে চালকদের সংঘবদ্ধ তোপের মুখে পড়তে হয় যাত্রীদের। বেশিরভাগ সময় একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংঘবদ্ধ শ্রমিকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে অনিরাপদ বোধ করেন ভুক্তভোগী যাত্রী। আবার অনেকে পাঁচ টাকার জন্য ‘ঝামেলা’য় না গিয়ে সেটি দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। পাঁচ টাকা বাড়তি ভাড়া নেয়ায় থানায় যাওয়ার মতো বাস্তবতা বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি।
অনর্থক বেশি ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় প্রকাশ্যে যাত্রীকে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে সিলেটে। নেহাত সাধারণ লোকও নন, একজন ব্যাঙ্কার ছিলেন ভুক্তভোগী। বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি পরলোকে চলে গেলেও ভাড়া নিয়ে তুঘলকি একটুও কমেনি, বরং চালকদের বেপরোয়া আচরণ আরও বেড়েছে।
সিলেটের মতো একটি মহানগরে স্ট্যান্ড টু স্ট্যান্ড দূরত্বে ভাড়া আদায় হচ্ছে কার্যত চালকের মর্জিতে। আর বৃষ্টি এলে তো যাত্রীর মাথায় একেবারে আকাশ ভেঙে পড়ে। তখন ১৫ টাকার ভাড়াটিও হয়ে যায় ত্রিশ টাকা। আবার এক স্ট্যান্ডের গাড়িকে বেশি দূরত্বের অন্য স্ট্যান্ডের বলে দাবি করে পথে নেমে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এসব কিছুই হচ্ছে প্রকাশ্যে।
অথচ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ড টু স্ট্যান্ড ভাড়া সুনির্ধারিত ও সুনিয়ন্ত্রিত থাকাটা অত্যাবশ্যক নিয়ম। তবে এ ব্যাপারে না সড়ক কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ আছে, না আছে সিটি করপোরেশনের কোনো ভূমিকা। নাগরিকদের জন্য বানানো নগরীতে নাগরিকরাই আজ গোনার বাইরে।
পরিস্থিতি দৃষ্টে, ফুটপাত বাণিজ্য বা এবম্বিধ বিষয়াদির সুফলভোগী হওয়া ছাড়া কর্তৃপক্ষের এসব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করার মতো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। তারপরও তাদের কাছেই একটু হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করা ছাড়া সাধারণ নাগরিকের আর বিকল্প পথ নেই।
তাই শেষ পর্যন্ত চাওয়া একটাই, যাত্রীসংখ্যা ও স্ট্যান্ডপ্রতি ভাড়া সুনির্ধারিত করে দেয়া এবং তার কঠোর বাস্তবায়নে নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ। আর যদি সম্ভব হয়, তবে নারী যাত্রীদের জন্যে অবশ্যই কিছু আলাদা সিএনজি বা টাউনবাসের ব্যবস্থা করা।