গণেশ বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে একটি হাতি। সনাতন ধর্মে এই হাতিরূপী সিদ্ধিদাতা গণেশের পূজা হয়। ইসলাম ধর্মে যারা ভালো জ্ঞান রাখেন, তারা জানেন যে, পবিত্র কোরআনে ১০৫ নম্বর সুরা আল-ফিল অর্থ আদতে হাতি। এই প্রাণীটির নামে একটি সুরা পর্যন্ত আছে।
হাতিরা আজ কেমন আছে? দেবতা গণেশের দেশ ভারতের কেরালা রাজ্যে ২০২০ সালের এই মে মাসেই বিস্ফোরকভর্তি আনারস খেয়ে একটি হাতির মৃত্যু হয়। ১৫ বছর বয়সী হাতিটি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তিন দিন ধরে পানিতে দাঁড়িয়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল হাতিটি।
আমাদের দেশের হাতিরা কেমন আছে? সার্কাসের নিষ্ঠুরতা তো পুরোনো ব্যাপার। ছোটবেলা থেকেই এই এত বড় প্রাণীটিকে জঙ্গল থেকে বিচ্ছিন্ন করে নানা রকম নির্যাতনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহার করা হয়। পিস্তল নিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি দেশে এখন তেমন একটা দেখা না গেলেও রাস্তায় হাতির শুঁড় ঠেকিয়ে চাঁদাবাজি চলছে হরহামেশা। এটি মোটামুটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমরা অনেকেই দেখছি, মেনেও নিচ্ছি।
হাতি টাকার কী বোঝে? কিন্তু তাকে বোঝানো হয়। আর যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে বোঝানো হয়, তার বিবরণ শোনা যে কারও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিছু হবে না। সেই হাতির সঙ্গে আমাদের দেখা হয় পথে-ঘাটে। টাকা দিই কিংবা এড়িয়ে যাই, যার যার গন্তব্যে চলে যাই, কিন্তু ক্ষণিকের দেখা সেই হাতির জীবন আসলে কেমন?
গত ১৭ মে ঢাকার এক রেললাইনের পাশে লোহার শিকল দিয়ে দুটি হাতি বেঁধে রাখা হয়েছিল। ট্রেন একটিকে ধাক্কা দেয়। বাচ্চা হাতি, ছোট ছোট চুল, ছোট শুঁড়, দাঁতও ঠিকমতো ওঠেনি। একেবারে কোলের বাচ্চা। তবে হাতি তো, বাচ্চা হলেও বেশ বড়সড়। সহজে তো প্রাণ যায় না। পায়ে বাঁধা লোহার শিকল নিয়ে রক্তপাত হতে হতে ধুঁকে ধুঁকে অনেকটা সময় মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে মরেছে। পাশের জন কি তার মা ছিল?
হাতিরা নাকি মায়ের গর্ভে থাকে প্রায় দুই বছর। হাতি পরিবারের খুনসুটি আমি দেখেছি। মানুষ মায়ের চেয়ে সন্তানের প্রতি স্নেহে হাতি মায়েরা একটুও পিছিয়ে নেই; শুধু মানুষের ভাষায় বলতে পারে না। এক দঙ্গল লোহার শিকল পায়ে নিয়ে এই দৃশ্য দেখতে হাতি মায়ের কেমন লেগেছিল! না, তাদের আবেগ বোঝার মতো উচ্চমাত্রার সংবেদনশীল আমরা কখনও হতে পারব না, তবে মানবজাতির সংবেদনশীলতা নিয়ে একেবারে হতাশ হবারও কিছু নেই।
কেরালায় বিস্ফোরকভর্তি আনারস খেয়ে হাতির মৃত্যুর ঘটনায় টাটা সন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান ভারতের শীর্ষস্থানীয় ধনী রতন টাটা একে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে তীব্রভাবে বিচার দাবি করেন। প্রতিবাদ করেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলিও।
আমাদের দেশেও প্রতিবাদ হয়েছে। প্রাণিপ্রেমীরা একের পর এক জড়ো হয়েছে বন অধিদপ্তরে। প্ল্যাকার্ড নিয়ে, ছবি এঁকে নানান ভাষায় প্রতিবাদ করেছে। যুক্তি দিয়েছে, বিচার চেয়েছে। আশা করা যায় সমাজের আরও উচ্চ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠিতরাও আসবেন।
হাতিদের দুঃখ বোঝার মানুষ সর্বস্তরে আছে। জানি না এই বাচ্চা হাতিটাই মানুষের হত্যাকাণ্ডের শিকার শেষ হাতি কি না। সেই সম্ভাবনা কম।
হাতি অনেক বিশালদেহী প্রাণী। শক্তিতে তার সঙ্গে কোনো মানুষের পেরে ওঠার প্রশ্নই আসে না, তবে তারা নিরীহ। গায়ের জোরে পারি না বলেই নানা নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে আমরা তাকে কাবু করি। হিংস্র নয় বলেই দেখামাত্র আমাদের পিষে মেরে ফেলে না। আমরাও তার সুযোগ নিই।
প্রাণী হই কিংবা মানুষ—একসময় আমরা সবাই সব হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে চলে যাব। বাচ্চা হাতিটিও পৃথিবীর যাবতীয় নিষ্ঠুরতাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে তার মাকে ছেড়ে অসীমের পথে চলে গেছে। অভিশাপ শব্দটির যৌক্তিক প্রমাণ না মিললেও এটি পৃথিবীর সব ভাষার অভিধানে আছে, সব ধর্মে আছে। যে হাতি নিজের ইচ্ছায় আমাদের শহরেও আসে নাই, পায়ে মোটা শিকল পরে নাই, সম্পূর্ণ আমাদের ভুলে এইটুকু বয়সে পা ভেঙে কাতরে মরল, কী হবে সে যদি অভিশাপ দেয়? আমরা সামলাতে পারব তো?
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাণী অধিকার রক্ষা কর্মী
ইমেইল: farzanaalamshampa@gmail.com