বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছায়া ভালোবাসা অর্থনীতি

  • সম্পাদকীয়   
  • ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ০০:২৪

ছায়া ভালোবাসা অর্থনীতি এমন একটি অর্থনীতি, যাকে ঘিরে আমরা তেমন চিন্তা করি না। অথচ এই অর্থনীতির আওতায় পরিবার, সমাজ তথা দেশ বলতে গেলে টিকে আছে। এই অর্থনীতির কথা মুখে বললেও চিন্তাও করি না এবং সে রকম গুরুত্বও দেই না। অনেকে অবশ্য বলে থাকেন যে, এই হিসাব এমন যে খাতায় আছে। অথচ গোয়ালে গরু নেই। কিন্তু এ কথাটি মোটেই ঠিক নয়। কেননা এর আলটিমেট সুবিধা আমরা কড়ায় গণ্ডায় পেয়ে থাকি। অবশ্য জিডিপিতে সরাসরি যোগ না হলেও, বাস্তবতার নিরীক্ষে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। আর এ বিষয়টি নিয়ে অর্থনীবিদরা বিভিন্ন আঙ্গিকে কম কথা বলেন না? মূলত এই অর্থনীতি হলো সহজাত প্রবৃত্তির আড়ালে বাবা অথবা মা কর্তৃক সন্তান-সন্ততি ও পরিবার আগলিয়ে রাখার প্রপঞ্চ। আর এটিকে ভিত্তি করে প্রকৃতিগত অমোঘ টানে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ ও ভালোবাসাসহ উদ্ভুত নিয়ামকের সূত্র ধরে নানা রকম কাজ পজিটিভ মিথস্ক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে এবং এর আওতায় সন্তানের যত্ন বা পরিচর্যা ও হাউজহোল্ডসহ বিবিধ কাজ স্বতস্ফূর্তভাবে আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হলো যে, এই সামগ্রিক কাজকর্ম মানি ভ্যালুর কভারে চিন্তা করি না। ভাবি, এগুলো তাদের একান্ত নিজস্ব অপরিহার্য কাজ। এর আবার মানি ভ্যালু কি? কিন্তু অবশ্যই এর মানি ভ্যালু আছে এবং জিডিপিতে পরোক্ষভাবে যোগ হয়। কিন্তু খাতা কলমে হিসাবের বাইরে থাকে। আসলে এটি ছায়ার মতো স্বকীয়তা নিয়ে অবস্থান করে থাকে।

পরিবারের ক্ষেত্রে যতই কাজ করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। আদিতে যে রক্ত সম্পর্ক ধর্মীয় বন্ধন বা সংঘবদ্ধ জীবন এবং নেতৃত্বের সৃষ্টি করেছিল, সে বিষয়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ ব্যাপারে ভালোবাসার আদলে স্বীকৃত স্নেহ, প্রেম, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, যোগাযোগ রক্ষা বা সংঘ গঠন ছাড়া মানুষের বসবাস করা সম্ভব নয়।

এ বিশ্বে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত মিলে প্রায় ২০৬টি রাষ্ট্র আছে এবং এ বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় আট শত কোটি, যার অর্ধেক হলো নারী। উন্নত বিশ্বে নারী অনেকাংশে মর্যাদা নিয়ে থাকলেও, আমাদের দেশে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীকূল তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। আর জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রে পুরুষকূল যা দাবী করে, আসলে তা নয়। এদিকে সংবিধানে সমধিকারের কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করেন। তবে শহরে যারা বাস করেন, সে ক্ষেত্রে মেয়েরা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও গ্রামের বেচারী মেয়েদের কি যে হাল? তা বলে শেষ করা যাবে না। সেই যে ভোর-রাত্রি থেকে কাজ শুরু করে, যেমন- সন্তানদের পরিচর্যা, ধান সিদ্ধকরণ, উঠান ঝাড় দেয়া, পানি আনা, নাস্তা তৈরি করা, দুধ দোহন করা, গরুর ঘাস দেয়া, ধান শুকানো, ধান ভানা. শ্বশুর-শাশুড়ীর দেখাশোনা, ক্ষেতে কার্যরত স্বামীকে খাবার পাঠানো, মুরগি, গরু বা ছাগল পালন, উঠানের পাশে শাক-সবজিতে পানি দেয়া, ইত্যাদি আরও কত কি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। আর এ সব কাজ করে মধ্য রাতের আগে ঘুমানোর ফুরসৎ পায় না। অথচ বাংলাদেশের কালচারে এটি চিরাচরিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এ ধরনের গৃহস্থালীর কাজ করার জন্যই নারীর জন্ম এবং যদিও তারা একান্ত নিরবে ভালোবাসার টানে তা করে থাকেন। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা এটি ছায়া ভালোবাসার অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা যে এতে অবদান রাখে, তদনুযায়ী মর্যাদা পায় না। সেহেতু জনৈক বিট্রিশ বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, They beset with so many household affairs without raising any question. Thus for fostering these phenomena put forth the voice of love of these voiceless women.

এতদ্ব্যতীত গৃহকর্তা হিসেবে সংসারকে ঘিরে বাবা যে বিভিন্ন আঙ্গিকে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বজনীনভাবে ‘মা’ ও ‘বাবা’ কে উচ্চ আসনে বসানো হয়েছে। এই দুব্যক্তির নিঃস্বার্থ, চিরন্তন ও স্বভাবজ অবদানের কথা; সব পর্যায়ে স্বীকার্য। যাহোক, অর্থনীতির দর্শন ও নরম অনুযায়ী বলা হয় যে, তাদের এ লাগাতার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড নাকি অর্থনীতির আওতায় নয় বিধায় অর্থের মূল্যে নিরূপণ করা হয় না। তবে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এ কৃষি নির্ভরশীল অর্থনীতিতে তাদের এ ভালোবাসাসুলভ কাজ যদি না হতো, তাহলে মনে হয় অর্থনীতি দুমড়ে পড়তো। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এটিকে অর্থনীতির আওতায় আনতে সচেষ্ট হয়ে উল্লেখ করেছিলেন যে, দেশের ১০ বছর বয়সী বা তদোর্ধ নারীগণের গৃহস্থালী কর্মকাণ্ডের ‘সময়’ বছরে ১৬,৬৪১ কোটি শ্রম ঘন্টা, যা অর্থের হিসেবে মূল্যায়ন করলে দাঁড়ায় আনুমানিক ২৪৯,৬১৫.০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাম ও শহুরে নারীর শ্রমের অংশ যথাক্রমে ৭৯% এবং ২১%, তাই মনে করি, তাদের এই ভালবাসাসুলভ গৃহস্থালীর কর্মকাণ্ড প্রসূত অবদান জিডিপিতে অবশ্যই বিবেচনায় আনা সমীচীন। নতুবা বৃক্ষের গোড়াতে অন্ধকার থাকলে কোনোভাবেই গাছের পুরোপুরি চেহারা যেমন দেখা যায় না। তেমনি আর্থ-সামাজিক দিক-দিয়ে যে কোনো পরিকল্পনা নেয়া হোক না কেন, সত্যিকার অর্থে শ্রম বিন্যাস ও বিশেষায়িত উৎপাদন নির্ণয় করা কখনো সম্ভব হবে না, সব জগাখিচুরী হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাক্কালে জিডিপিতে নারী ও পুরুষের কার কত অংশ, তা কোনক্রমেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা থাকবে না। এদিকে অধুনা বিট্রিশ এক জরীপে দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা কাজের প্রতি অধিকতর আন্তরিক এবং এ সূত্র ধরে সংসার বা সমাজের মঙ্গল কামনায় তুলনামূলক তারা অবদান বেশি রাখে। মূলত মেয়েরা হিসেবী এবং নীতিনিষ্ঠ এবং সাধারণত মেয়েরা সিদ্ধান্ত নেয় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে। কিন্তু পুরুষরা ততটা না ভেবে পৌরুষোচিত আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিধায় মাঝে-মধ্যে ছন্দপতন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই আঙ্গিকে আনুপাতিক হারে মেয়েদের এ ভালোবাসাপ্রসূত কর্মকাণ্ড খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

বিগত ১০/০৯/২০২৫ইং তারিখে পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশীল কাজের অবদান প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে হিসাব করা হয়েছে। এ সূত্র ধরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস) জানায় যে, রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো, শিশু ও বৃদ্ধের যত্ন নেওয়া; কিংবা অসুস্থের সেবা, ইত্যাদি হিসাবের মধ্যে আনা হয়েছে। এসব অদৃশ্য শ্রমের বার্ষিক অর্থনৈতিক মূল্য দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন বা ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর এই অঙ্ক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১৮ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। এর মধ্যে নারীর অবদান প্রায় ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ অবদান পুরুষের, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লাখ কোটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে সাত গুণ সময় দেন অবৈতনিক কাজে। একজন নারী বছরে প্রায় ২১শ ঘন্টা সময় দেন রান্না, ঘর সামলানো এবং শিশু ও প্রবীণদের সেবা যত্নে। অন্যদিকে, একজন পুরুষ এ কাজে ব্যয় করেন গড়ে ৩০০ ঘন্টা। অর্থাৎ মূল্য নির্ধারণের বাইরের কাজে ৮৮ শতাংশই করে থাকেন নারী। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার (০৯/০৯/২০২৫ইং) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিসিএস অডিটরিয়ামের প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টে (এইচপিএসএ) এ তথ্য জানানো হয়। অবশ্য ২০২১ সালের ‘সময়’ ব্যবহার জরিপ এবং যুগপৎ ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ হিসাব করা হয়েছে। সাধারণত অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য হিসাব নির্ধারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে র) প্রতিস্থাপন খরচ পদ্ধতি ও রর) সুযোগের খরচ পদ্ধতি। এর পর কাজের ধরন বিবেচনা করে সাধারণ পদ্ধতি, বিশেষ পদ্ধতি ও হাইব্রিড পদ্ধতির সমন্বয়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্যায়ণ করা হয়। মূলত হাইব্রিড পদ্ধতিকে বিশ্বজুড়ে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণে সুপারিশ করা হয়। আর এ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক বিবিএসের পক্ষ থেকে অবৈতিক কাজের আর্থিক মূল্য নির্ণয় করা হয়েছে।

উপর্যুক্ত হিসাব অবশ্যই যুগান্তকারী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো যে দেশের জিডিপিতে প্রায়োগিকভাবে কিভাবে প্রতিফলিত করা হবে। এটিকে কি সামগ্রিকভাবে দেখানো হবে? নাকি শুধু হিসাবের জন্যই খাতা কলমে থাকবে। অবশ্য এ হিসাব যদি সামগ্রিকভাবে টানা হয়। তাহলে জিডিপির কলেবরে কি রকম চেহারা হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন থেকেই দেখতাম; অর্থনীতি নরম হিসেবে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর অবদান হিসাবে আনা হয় না। অথচ সেই কাজ যদি চাকর বা চাকরানী করে, তাহলে সসম্মানে বিবেচনায় আনা হয়। তাই আমি অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো যে, এর সামগ্রিক প্যারামিটার বিশ্লেষণপূর্বক একটি প্রতিবেদন যেন দেশবাসীর গোচরে আনা হয়। তাহলে সংশ্লিষ্ট সবার সম্যক ধারণা হবে এবং হিতকরও কম হবে না?

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত।

এ বিভাগের আরো খবর