কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা এআই) হলো বর্তমান বিশ্বের এক অনন্য প্রযুক্তিগত বিপ্লব। এটি মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সৃজনশীলতার অনুকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এর ব্যাপ্তি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে, শিল্প, স্বাস্থ্য, ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও গবেষণার মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রেও এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এআই টুলস যেমন ChatGPT, Gemini, Claude, GitHub Copilot, Grammarly, MidJourney কিংবা DALL•E ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য প্রতিদিনের অপরিহার্য সহায়ক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একদিকে এগুলো জ্ঞান আহরণ, তথ্য বিশ্লেষণ, গবেষণা ও সৃজনশীলতাকে সহজতর করছে; অন্যদিকে একাডেমিক সততা, মৌলিকতা এবং গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্নও তুলছে। তাই এআই ব্যবহারের জন্য একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষা ও গবেষণায় এআই টুলসের বিস্তার:
বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এআই ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা সহজেই এআই টুলস ব্যবহার করে লেকচার নোট তৈরি, প্রবন্ধ রচনা, অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান কিংবা থিসিসের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করছে। গবেষণায় তারা লিটারেচার রিভিউ, ডেটা অ্যানালাইসিস, পরিসংখ্যান মডেল তৈরি এমনকি জটিল গ্রাফ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরিতেও এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে। শিক্ষকরাও এআই ব্যবহার করছেন পাঠ পরিকল্পনা, গবেষণার প্রাথমিক ধারণা বা নতুন লেকচার সামগ্রী তৈরি করতে। যেমন একজন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র যখন কোড লেখায় সমস্যায় পড়ে, তখন GitHub Copilot তাকে নির্দিষ্ট সমাধান বা বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তাব করতে পারে। একজন গবেষক যখন শতাধিক প্রবন্ধের রিভিউ করতে চান, তখন ChatGPT বা Elicit দ্রুত সেই কাজকে সারসংক্ষেপ আকারে উপস্থাপন করতে পারে। অন্যদিকে একজন শিক্ষক জটিল কোনো অ্যালগরিদম শেখানোর আগে MidJourney বা DALL•E ব্যবহার করে চিত্র তৈরি করতে পারেন, যা শিক্ষার্থীদের বোঝা সহজ করবে।
তবে এই সুযোগের পাশাপাশি সমস্যা হলো—শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা চিন্তা না করে সরাসরি এআই-সৃষ্ট কন্টেন্ট জমা দিচ্ছে। ফলাফল হলো, তাদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে এআই-সৃষ্ট লেখা ব্যবহার করলে তা নকল বা একাডেমিক অসততার মধ্যে পড়ে। এই দ্বৈত বাস্তবতাই নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছে।
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা ও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট:
বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহারের নীতি নির্ধারণে পদক্ষেপ নিয়েছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, পরীক্ষায় এআই ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও অ্যাসাইনমেন্ট বা গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমায় অনুমোদিত। এমআইটি গবেষণাপত্র বা প্রকল্পে এআই ব্যবহার করলে তা স্পষ্টভাবে ডিক্লেয়ার করার বিধান চালু করেছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক সততা বজায় রাখতে ঘোষণা দিয়েছে যে, এআই ব্যবহারের তথ্য গোপন করা এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে গণ্য হবে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এআই-কে শিক্ষার সহায়ক টুল (Assistive Tool) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে প্লেজারিজম ও একাডেমিক অসততার ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। এই উদাহরণগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। প্রথমত, এআই-কে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়, কারণ এটি বিশ্বব্যাপী শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, স্পষ্ট নিয়ম ছাড়া এআই ব্যবহার করলে একাডেমিক মান ভেঙে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষক—তিন পক্ষকেই সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করে নীতি প্রণয়ন করাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় এআই ব্যবহারের ধারা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও এর বিস্তার দ্রুত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যেই এআই ব্যবহার করে নোট তৈরি, অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস লিখছে। গবেষকরা ডেটা প্রসেসিং বা লিটারেচার রিভিউতে এর সহায়তা নিচ্ছেন। তবে এই ব্যবহার এখনো নিয়ন্ত্রিত নয়, যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক চিন্তার প্রতি অনীহা এবং নকলের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ডিজিটাল বিভাজন। সব শিক্ষার্থী সমানভাবে প্রযুক্তিতে দক্ষ নয়। যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি ও প্রযুক্তিতে পারদর্শী, তারা সহজেই এআই ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ বা প্রযুক্তি-অপরিচিত শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে। এই বাস্তবতায় এআই নীতিমালা শুধু একাডেমিক সততা রক্ষার জন্য নয়, বরং সমতা নিশ্চিত করার জন্যও জরুরি হয়ে উঠেছে।
এআই নীতিমালা কেন জরুরি:
নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহার একাধিক সমস্যা তৈরি করবে। প্রথমত, একাডেমিক সততা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি শিক্ষার্থীরা পুরো অ্যাসাইনমেন্ট বা থিসিস এআই দিয়ে লিখে জমা দেয়, তবে তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের কোনো সুযোগ থাকবে না। দ্বিতীয়ত, গবেষণার মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এআই ভুল তথ্য বা কল্পিত রেফারেন্স দিতে পারে (hallucinations), যা যাচাই ছাড়া ব্যবহার করলে গবেষণা আনরিল্যাইবেল হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, শিক্ষকরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বিভ্রান্ত হবেন, কারণ কোনটা শিক্ষার্থীর নিজের অবদান আর কোনটা এআই-এর তৈরি—তা আলাদা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে নীতিমালা ছাড়া এআই ব্যবহারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হবে। শিক্ষকেরা ভাববেন শিক্ষার্থীর কাজ আসলে তার নিজের নয়, আবার শিক্ষার্থীরা মনে করতে পারে শিক্ষক অযথা সন্দেহ করছেন। এভাবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই এক ধরনের অনাস্থা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাবে।
আমাদের দেশের জন্য প্রস্তাবিত নীতি:
আমি মনে করি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এখনই একটি সুসংগঠিত ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই নীতিমালায় প্রথমত স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যে কোনো কাজেই এআই ব্যবহার করলে তা উল্লেখ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, থিসিস বা গবেষণাপত্রে আলাদা সেকশনে ‘এআই ব্যবহারের ধরন’ (Usages Type) স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ‘ব্যবহারের সীমারেখা’ (limit) নির্ধারণ করতে হবে। যেকোনো পরীক্ষায় এআই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে, পরীক্ষার হলে যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইস নিষিদ্ধ করতে হবে, কারণ এটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র। অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টে সীমিত ব্যবহার অনুমোদিত হতে পারে, তবে ব্যবহারের ধরন ও প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে জমা দিতে হবে। গবেষণায় এআই ডেটা বিশ্লেষণ, লিটারেচার সারসংক্ষেপ বা ভিজ্যুয়ালাইজেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মৌলিক গবেষণার যুক্তি বা ফলাফল তৈরিতে এর ওপর নির্ভর করা যাবে না।
তৃতীয়ত, শিক্ষকদের জন্য পাশাপাশি গাইডলাইন থাকতে হবে। প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে এমনভাবে যাতে সরাসরি এআই দিয়ে সমাধান করা সম্ভব না হয়। এজন্য হাইয়ার থিঙ্কিং ও বিশ্লেষণভিত্তিক প্রশ্ন করার উপর জোর দিতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট প্রক্রিয়াভিত্তিক (Process based) করতে হবে—চূড়ান্ত ফলাফলের পাশাপাশি কাজের ধাপগুলো জমা দিতে হবে। পাঠদানে শিক্ষকরা এআই-কে সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, যেমন জটিল বিষয় ব্যাখ্যায় ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরি করা।
চতুর্থত, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মশালা আয়োজন করতে হবে। এতে তারা এআই-এর সীমাবদ্ধতা, নৈতিকতা ও কার্যকর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
সবশেষে, বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের বদলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জাতীয় নীতি প্রণয়ন করা অপরিহার্য। এতে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে এআই ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় সামঞ্জস্য বজায় থাকবে।
এটা সত্য যে,- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় এর ব্যবহার একদিকে যেমন সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিচ্ছে। সঠিক নীতিমালা ছাড়া এই প্রযুক্তি একাডেমিক সততা ও মৌলিকতাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে, আবার সঠিকভাবে ব্যবহার করলে শিক্ষার মান, গবেষণার গতি এবং সৃজনশীলতা বহুগুণে বাড়াতে পারে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখনই জরুরি একটি সুস্পষ্ট, ভারসাম্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং গবেষক—সবার দায়িত্ব, অধিকার ও সীমারেখা নির্ধারিত থাকবে।
লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।