জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র ও প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহের অনুজ শেখ রাসেলের শুভ জন্মদিন আজ।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধু তার প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নাম রাখেন ‘রাসেল’। এই নামকরণে মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
শৈশব থেকেই দুরন্ত প্রাণবন্ত রাসেল ছিলেন পরিবারের সবার অতি আদরের। কিন্তু মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই প্রিয় পিতার সঙ্গে তার সাক্ষাতের একমাত্র স্থান হয়ে ওঠে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। তবে সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সালে তিনি নিজেই বন্দি হয়ে যান।
শেখ রাসেলের ভুবন ছিল তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাতা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ঘিরে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। তখন রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তাই নরপশুরা নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। শহীদ হন সবার অতি পছন্দের, আদরের, ভালবাসার শেখ রাসেল।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছর থেকে শেখ রাসেলের জন্মদিনটি ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত, নির্ভীক।
‘১৯৬৪ সালে রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্স এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়।
‘মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’
সূত্র: শেখ হাসিনা, ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’
১৯৬৬ সালে কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণে তার মন খারাপ থাকত।
কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে।
“জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরে ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।”
১৯৬৭ সালে কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৭ সালের ১৪-১৫ এপ্রিলের অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে।
“আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে। তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।”
১৯৭১ সালে রাসেল তার মা ও দুই আপাসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। পিতা বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি এবং বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল চলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে। মা ও আপাসহ পরিবারের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হন। রাসেল ‘জয় বাংলা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইরে তখন চলছে বিজয়-উৎসব।
শেখ রাসেলের জন্মদিনটিতে শুধু দিবস পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে শেখ রাসেল যে পরিবারে যে পরিবেশে বেড়ে উঠতো সেই পরিবারের আদর্শ ও ছোট্ট রাসেলের ছোট্ট জীবনের মানবিক দিকগুলো সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে তা অনুধাবন ও অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারলেই দিবস পালন সফল হবে। দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।
৫৯তম জন্মদিনে শেখ রাসেলের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। এ দেশের শিশু-কিশোর, তরুণ প্রজন্মের কাছে শেখ রাসেল এক ভালোবাসার নাম, শেখ রাসেল আজ দেশের আনাচে-কানাচে এক মানবিক সত্তা হিসেবে সবার মাঝে বেঁচে আছেন। এরকম জন্মদিন যেন আর কোনো শিশুর জীবনে না আসে।
শেখ রাসেল, চিরদিন বেঁচে থাকবে তুমি প্রিয়। তোমার শরীরের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আত্মার মৃত্যু হবে না কোনোদিন। তুমি বেঁচে আছো আমাদের সবার অন্তরে। জননেত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই শহীদ শেখ রাসেলের শুভ জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা। জয় বাংলা।
তথ্য সংগ্রহ: বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট; পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ এবং প্রকল্প পরিচালক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।