জব্বার মিয়া একজন কৃষক। গাইবান্ধা সদর হাসপাতলে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছেন। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কী সমস্যা? ৫০/৫২ বছর বয়সী জব্বার মিয়া জানালেন, ‘একদম উচি (রুচি) নাই বাহে মুখত। কিছু খাবারে পারো না।’ ডাক্তার বললেন, কেন কী খেতে পারেন না? কেন মনে হলো রুচি নাই? রোগী জানালেন, সবে খাবার পাও শুধু ভাত খাওয়া কমি (কমে) গেইছে। আগত নুন, দিয়াই কেজি টেক চাইলের ভাত খাবার পাইরতাম। এখন আর পারো না। ভাত খাইতে না পাইল্লে কীসের কী? মোখ ওষুধ দাও, বাহে।’
জব্বার মিয়ার মতো অসুস্থতা বাংলাদেশের অনেক মানুষেরই। ভাতনির্ভর জীবন আমাদের। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে যে, দেহের অধিকাংশ সমস্যা নাকি এই ভাত মানে শর্করা থেকে উদ্ভূত। তাই রোগ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেই ভাত কম খান বা খেয়েন না ধরনের প্রেসক্রিপশন দেবেনই। ভাতপ্রিয় বাঙালির তাতে কষ্টের শেষ নেই। ‘ভাত ঘুম’, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’, ‘মামার বাড়ি যাই দুধ-ভাত খাই’ এই প্রচলিত প্রবাদ তাহলেতো মিছে হয়ে যাবে। ভাত ছাড়া আর কী খাব, কেমন করে খাব?
হলদে ভাত
ছোটবেলায় নীলফামারিতে দাদার বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে ৮/১০ জন মানুষ বসেছেন। এরা আমাদের জমিতে কাজ করে। দাদির তত্ত্বাবধানে একটি বড় গামলায় করে হলুদ রঙের ভাত, সবজি, কাঁচামরিচ, পিঁয়াজ এনে মানুষগুলোকে খেতে দেয়া হচ্ছে। লক্ষ করলাম আমরা যে ভাত খাই, এটা সেইরকম ভাত নয়, আবার খিচুড়িও নয়। ছোট ছোট দানার গোল গোল ভাত। পরে জানলাম একে কাউন বলে। উত্তরাঞ্চলে প্রচুর কাউন হয় এবং বছরের এই সময়টাতে মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ কাউনের ভাত খায়। এটি পুষ্টিকর, অনেকক্ষণ পেটে থাকে।
আরেকদিন দেখলাম এই মানুষগুলোই পাকা কাঁঠাল ভেঙে কাঁঠাল দিয়ে কাউনের ভাত খাচ্ছে। আমারতো আর বিস্ময় যায় না। অগত্যা দাদি আমাকে কাউনের ভাত পিঁয়াজ, তেল, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি দিয়ে মেখে দিলেন। চাচি ঘন দুধ দিয়ে কাউনের পায়েস করে দিলেন। উহ কী স্বাদ সেই খাবারের!
পরে দেখি ঢাকা শহরের অর্গানিক খাদ্য বিক্রেতারা কাউনের মান উন্নীত করে তাদের দোকানে দাম দিয়েই কাউন বিক্রি করছে। কাউন দিয়ে ভাত হয়, পায়েস হয়, খিচুড়িও হয়। তবে কাঁঠাল দিয়ে খেতে কেমন লাগবে, সেকথা ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।
বউখুদ
এরপর পেলাম খুদভাত। যখন সংসারে চাল ঝাড়া-বাছার রেওয়াজ ছিল, তখন চালের খুদ বের করে দরিদ্র মানুষকে দিয়ে দেয়া হতো। মুরগিকে খেতে দেয়া হতো। মাঝেমধ্যে শখ করে পোলাওর চালের খুদ রান্না করা হতো। পরে দেখলাম চালের খুদ দিয়ে খুব মজাদার খুদভাত হচ্ছে। বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ এলাকায় এই খুদ রান্নার নাম বউখুদ। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বলে বউভাত। নাম যা-ই হোক খাওয়ার পদ্ধতি কিন্তু একই।
ইদানীং তো বিভিন্ন ছোট রেস্তোরাঁতে ভাতের পাশাপাশি পোলাওর চালের বউখুদ রান্না করে রাখা হচ্ছে। খুদের চালের খিচুড়ি, আদা-হলুদ-শুকনা মরিচ-পিঁয়াজ বাগার দিয়ে যে রান্না হয়, তাই বউখুদ। সঙ্গে থাকতে হবে ব্যাপক ঝাল দিয়ে বেগুন, আলু, শুঁটকি, কালোজিরা ও সরিষা ভর্তা। এই ভাত খেতে পারেন সকালের নাস্তাতেও। এছাড়া পোলাওর চালের খুদের সঙ্গে সুজি মিশিয়ে খুব মজাদার পায়েস রান্না হতে পারে।
নাকফুল নয় বাঁশফুল
সিলেট, চট্টগ্রামে খুব পরিচিত বাঁশফুল চাল। এসব এলাকার সাধারণ ভাতের দোকানে ভাত খেতে বসে দেখবেন বেশ একটা চমৎকার গন্ধ ভেসে আসছে। ভাতগুলোও খুব সুন্দর, দেখলে মনে হবে বাঁশমতি চাল। অথচ এই বাঁশফুল চাল দেখতে গোল গোল কিন্তু ভাত হয় লম্বা। কী তার গন্ধ এবং স্বাদ।
যেকোনো উৎসবে বাঁশফুল চালের ভাতের সঙ্গে খেতে দুর্দান্ত লাগবে মাছ, মুড়োঘণ্ট, ভুনা খাসির মাংস ও বড় মাছের কালিয়া। পাশাপাশি চলতে পারে নানা ধরনের ভর্তা, চিকন ঝুড়ির আলুভাজি ও ঘন সোনা মুগের ডাল। ঠিক একইভাবে সবজি মিশিয়ে এই চালের ল্যাটকা বা পাতলা খিচুড়িও খুব মজা লাগে।
রেশনের আতপ
আমাদের দেশে আগে খিচুড়ি বা পিঠা বানানোর জন্য ব্যবহৃত হতো মোটা আতপ চাল। ৭০/৮০ দশকে ঢাকা শহরে এই আতপ চাল রেশনে দেয়া হতো। এখনও চালের বাজারে খুঁজলে দেশি মোটা আতপ চাল পাওয়া যায়। বেশ মিষ্টি ঘ্রাণ রয়েছে এই চালের। কিন্তু মোটা দানা বলে এবং দ্রুত গলে যায় এ কারণে এ চাল দিয়ে পোলাও রান্নাটা খুব একটা জম্পেশ হয় না, বরং ঝুঁকিপূর্ণই হবে বলা যায়। গ্রামে বড় কোনো দাওয়াত হলে বেশি করে দুধ দিয়ে মোটা আতপ চালের ফিরনি রান্না করা হয়।
দাদখানি চাল, মসুরির ডাল
ছেলেবেলায় পড়া যোগীন্দ্রনাথ সরকারের খুব মজার ছড়া ‘কাজের ছেলে’র কথা আমাদের মনে থাকার কথা-
“দাদখানি চাল, মসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,
দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।
পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল
ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়, ছিঁড়ে দেবে চুল।”
ছড়াটা পড়ার সময় কেবলই মনে হতো এই দাদখানি চাল জিনিসটা কী? কেমনইবা স্বাদ? দাদখানি চাল ছিল এই বাংলার খুব পরিচিত। কারণ এই চালের মধ্যে রয়েছে জিকং। জিংক শরীরে রোগ প্রতিরোধে খুব কার্যকর। আর তাই অসুস্থ মানুষের জন্য এই দাদখানি চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দেয়া হতো। এখনও খুব
ভাতময় জীবন বাঙালির
কেন বাঙালির জীবন ভাতময়, কেন বাঙালিকে নিন্দা করে বলা হয় ‘ভেতো বাঙালি’, কেন সবকিছু খাওয়ার পরও এক মুঠো ভাত না খেলে জীবন অর্থহীন মনে হয়? আমরা যদি চালের ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখব এই বাংলায় দুইশরও বেশি ধরনের চাল হতো একসময়। প্রতিটি চালের আলাদা আলাদা রং, চেহারা ও স্বাদ এবং প্রয়োজন। একেক চাল হতো একেক ঋতুতে।
দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, শিল্পকারখানা, বসতভিটা তৈরি হওয়ায় প্রথম ধাক্কা পড়ল ফসলি জমির ওপর। ফসলি জমির ওপর টান পড়ায় খুব সূক্ষ্ম ধরনের বা সেনসেটিভ চালের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
মা চাল
সব চালের মা বা মূল বলা হয় ‘রাইদা চাল’কে। চিকন এই চালটি কীভাবে কৃষকরা খুঁজে পেয়েছেন, তা নিয়ে গল্পও প্রচলিত আছে। অনেককাল আগে খুলনা এলাকার জেলেরা খাদ্যের খোঁজে নদীর ধার দিয়ে হাঁটার সময়, মাঝে মাঝে শুকনো ঘাস তুলে নিয়ে তাতে আগুন দিয়ে মাছ পুড়িয়ে খেতেন। এরাই একবার লক্ষ করলেন যে তারা ওই গাছ পুড়িয়ে ফেললেও সেখান থেকে কিছুদিন পর ধানের চারা বের হয়েছে। এর মানে ঘাস থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই রাইদা চাল।
রাঁধুনি কেন পাগল হলো?
রাঁধুনিপাগল চালটা বিখ্যাত এর গন্ধের জন্য। এর ঘ্রাণ এতই তীব্র ও মিষ্টি যে রান্নার সময় বাঁধুনি পাগল হয়ে যেত এর সুবাসে। মাঝে হারিয়ে গেলেও কৃষকরা এখন আবার নতুন করে এই ধানের উৎপাদন শুরু করেছে। রাঁধুনিপাগল চালের নাম শুনলেই বোঝা যায় এর মরতবা। খুব ঝরঝরে পোলাও আর চমৎকার পায়েস রান্না করা যায় এই চালের।
আবার কাজলদিঘা, লক্ষীদিঘা, কালারাই নামের ধানগুলো বর্ষা ও বন্যাতেও টিকে যায়। ভাদ, কালোশনি, কুমরি এসব ধান খরাতেও জন্মে। আমাদের দেশে জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে এসব ধানের আবাদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত। এখন জলবায়ু পরিবর্তনকে সামনে রেখে কৃষিবিষয়ক গবেষকরা এমন চালের খোঁজ করছেন, যা দুর্যোগেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
বিন্নি চালই স্টিকি রাইস
জুমে যে বিন্নি ধান হয়, তা থেকে কালো, লাল এবং সাদা বিন্নি চাল পাওয়া যায়। জুমের এই চালের স্বাদ অনন্য। বেশ আঠালো হয় এই চালের ভাত ও খিচুড়ি। রান্নার সঙ্গে সঙ্গে গরম গরম খেতে হয়, নতুবা ঠান্ডা হয়ে গেলে জমে শক্ত হয়ে যায়। খোসাসহ মুগের ডাল দিয়ে বিন্নি চালের খিচুড়ির স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। বিন্নি চালের পিঠা ও পায়েস দুই অনবদ্য। অধুনা ঢাকা শহরের বড় থাই ও কোরিয়ান রেস্টুরেন্টে এই চাল দিয়েই স্টিকি রাইস উইথ ম্যাংগো অ্যান্ড মিল্ক সার্ভ করা হয়। এটি জনপ্রিয় খাবার।
উৎসব
বেশ আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম রাজশাহীর একজন কৃষক তার জমিতে ১৫০ ধরনের ধান উৎপাদন করছেন। তিনি ভাবছেন কৃষকরা পুরোনো কিছু ধান উৎপাদন করুক। তিনি কৃষকদের নিয়ে নবান্ন উৎসবও পালন করেন। তখন এসব হারিয়ে যাওয়া চাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আইটেম রান্না করে অতিথিদের খাওয়ানো হয়। তিনি পঞ্চাশের বেশি বছর ধরে তার গ্রাম দুবোইলে এই চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। খোঁজ নিতে হবে এই উৎসব এখনও চলছে কি না?
ভাতের অভাবই বড় অভাব
এদেশে এত বেশি মানুষের ভাতের জোগান দিতে হয় বলে এখন কৃষকরা ধান নিয়ে গবেষণা করতে পারেন না। তাদের বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা অনুযায়ী এমন ধান আবাদ করতে হচ্ছে, যার ফলন অনেক বেশি। চিকিৎসকরা যতই বলুন না কেন ভাত কম খেতে, কিন্তু ভাতের চাহিদা বাড়ছেই বাঙালির। সময়মতো চাল বাজারে না পেলে কবির মতো বাঙালিও রেগেমেগে বলে উঠতে পারেন-
“সর্বপরিবেশগ্রাসী হলে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী নালা’…
ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।”
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন