বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জন্মদিনের শুভেচ্ছা: মানবিক ও সাহসী মুনতাসীর মামুন

  • তপন পালিত   
  • ২৪ মে, ২০২২ ১৬:১৯

মুনতাসীর মামুনের বক্তৃতায় একটা বিষয় সুম্পষ্ট করে বলেন যে, ১৯৬৮ সাল থেকে রাস্তায় আছেন তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপক্ষে যেকোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার তার আছে। অপর পক্ষে যিনিই থাকুন না কেন। এমনকি নিজের চাচা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনেক কাজের সমালোচনা করে পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আপন চাচার বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখে প্রতিবাদ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াকালীন ড. মুনতাসীর মামুন আমাদের দ্বিতীয়বর্ষে ইডরোপের ইতিহাস পড়াতেন। ক্লাসে রেনেসাঁ পড়ানোর সময় বলেছিলেন ইতিহাস পড়তে হলে ধর্মকে সব কিছুর ওপরে রাখতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে ইতিহাসকে মিলিয়ে নিলে ইতিহাস বুঝতে সমস্যা হবে। তখন বিষয়টি বুঝতে পারিনি। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করেছি। ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের তত্ত্বাবধানে ‘যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন (১৯৭১-২০১২)’ নিয়ে গবেষণা কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনে সাহসী মুনতাসীর মামুনের অবদান সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য যেমন অবিরাম লিখেছেন, তেমনি মাঠের আন্দোলনে থেকেছেন সক্রিয়। আমার মতো অনেক তরুণকে মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির লেখনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মুনতাসীর মামুন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে মুনতাসীর মামুনের লেখালেখি বিষয়ে ১২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও মুনতাসীর মামুনের লেখালেখি ও অন্য অনেক বিষয় বাকি রয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে শুধু লেখালেখি নয়, আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা মুনতাসীর মামুনের আজকের মুনতাসীর মামুন হয়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি লেখালেখির জন্য বিএনপি জোট সরকারের সময়ে ২০০২ সালে কারাবরণ করেন।

ছাত্রাবস্থায় অধ্যাপক মামুন আমাদের বলেছিলেন সামাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন হয়েছে যে, এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি বা সেনাবাহিনী প্রধান হতে পারবেন না, বা হতে দেয়া হবে না। তখন মাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তাই এত কিছু বুঝতে পারিনি। পরবর্তীকালে অবশ্য মুনতাসীর মামুনদের লেখালেখি ও দাবির ফলেই বঙ্গবন্ধুকন্যার সময়ে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই উদ্যোগটি সত্যিই প্রশংসনীয়।

এরপর ছাত্রজীবন শেষে এম ফিল করার সময়ে স্যারের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়। তখন একদিন খুলনায় গিয়েছি একটি কাজে। আমাদের এক সহপাঠী আমাকে জড়িয়ে ধরে কুশলাদি জানার পর মামুন স্যার কেমন আছেন জানতে চাইল। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। সবাই যেখানে স্যারকে ভয় পায় সেখানে সে স্যারের খবর নিচ্ছে! কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বলল যে, মামুন স্যারের ট্রাস্টের টাকায় পড়ালেখা করে আজ সে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। মুনতাসীর মামুন স্যার যে বিভাগের দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের নিজের ট্রাস্টের টাকায় পড়াতেন তা ছাত্রাবস্থায় জানতেই পারিনি। স্যারকে যখন বিষয়টি জিজ্ঞেস করলাম তখন তিনি বললেন, আমি কি মানুষকে জানানোর জন্য এসব করি যে তোমাদের বলব।

অন্য আরেকদিন স্যারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় মুক্তিযুদ্ধ কোষের কাজ করছি এই সময়ে একজন মহিলা সঙ্গে একটি মেয়েকে নিয়ে স্যারের বাসায় ঢুকলেন। স্যারকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছেন। স্যার বললেন, সব ঠিক আছে ‘বিজনেস টক’ করো, বিষয় কী বলো। মহিলা মেয়ের পরীক্ষার ফিস জমা দিতে হবে বলে জানালেন। স্যার সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দিলেন। আমি তাকিয়ে আছি দেখে মহিলা জানালেন যে, তার এই মেয়েটিকে স্যার পড়াচ্ছেন। পরে জানতে পারলাম এই মহিলা শিক্ষকদের কোয়ার্টারের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। মুনতাসীর মামুন-ফাতেমা ট্রাস্টের মাধ্যমে মুনতাসীর মামুন গরিব ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন যা পরবর্তীকালে কাজের সুবাদে জানতে পেরেছিল। এ তো গেল মানবিক দিকের কিছু।

এখন আমার দেখা সাহসী মুনতাসীর মামুন সম্পর্কে কিছু কথা বলব। স্যারের সঙ্গে কাজ ও এম ফিল করার সুবাদে বেশি সময় থাকা হতো তার সঙ্গে। এই সুযোগে নির্মূল কমিটির বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম। মামুন স্যার যখন বক্তৃতা করতে মঞ্চে ওঠেন, তখন দর্শক সারিতে একটু নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। কেন এমন হয় বুঝতে কিছু সময় লেগেছিল। মামুন স্যার বক্তৃতায় এমন কিছু কথা বলবেন যে, তা অনেকের বলার সাহস নেই বা বলতে চান না। কিন্তু কোনো অন্যায় হলে সেটার প্রতিবাদ তিনি দৃঢ়কণ্ঠে করবেন এটা সবাই জানত তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকতেন। তিনি সব সময় দর্শক-শ্রোতার মন বুঝে বক্তৃতা করেন বলে মনে হয়েছে। কারণ কখনই অযথা বক্তৃতা দীর্ঘ করেন না। যা প্রয়োজন তাই বলে শেষ করেন।

মুনতাসীর মামুনের বক্তৃতায় একটা বিষয় সুম্পষ্ট করে বলেন যে, ১৯৬৮ সাল থেকে রাস্তায় আছেন তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপক্ষে যেকোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার তার আছে। অপর পক্ষে যিনিই থাকুন না কেন। এমনকি নিজের চাচা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার অনেক কাজের সমালোচনা করে পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আপন চাচার বিরুদ্ধে পত্রিকায় লিখে প্রতিবাদ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সামরিক সরকার, জোট সরকার বা বর্তমান সরকারের যেসব সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে মনে করেছেন তখনই দৃঢ়ভাবে পত্রিকায় লিখে বা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।

অনেকের মতো তিনি শুধু এসি রুমে বসে বক্তৃতা করে বা ক্লাস নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাজপথে থেকে দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার এই সাহস ও আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা আমাদের মতো অনেক তরুণকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে উজ্জীবিত করেছে। তার পরিবার মানস গঠনে সহায়তা করলেও পরিবারের পরিচয়ে তিনি পরিচিত হননি।

পরিবারকে পিছনে রেখে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছেন। পিতৃব্য ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্নেহ পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু নিজের কর্মগুণে তাদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিলেন। যদিও একটি লেখায় মুনতাসীর মামুনের আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে অবদান তুলে ধরা সম্ভব নয়। তারপরও এই লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে মানবিক ও সাহসী মুনতাসীর মামুনের ভূমিকা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।

৭২তম জন্মদিনে আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা স্যার! জাতিকে আপনার আরও অনেক কিছু দেয়ার আছে। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক: গবেষক-প্রবন্ধকার। সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর