আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায়। জুনের শেষ সপ্তাহে উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ চান না। এটা তিনি আগেও বলেছেন। এটা তার বড় ও উদার মনের পরিচয় বহন করে। তারপরও একশ্রেণির মানুষ পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে রাখার আবদার করে চলেছেন। বলা হচ্ছে, সর্বস্তরের মানুষ শেখ হাসিনার নামে পদ্মা সেতুর নাম চাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। অমর শিল্পী মান্না দে’র গাওয়া সে গানটিই হোক পাথেয় “হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে”। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম এদেশের মানুষের হৃদয়ে লেখা আছে এবং থাকবে। যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে এবং তা থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
এটা কেউ অস্বীকার করবে না এবং সবাই জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপেই এই পদ্মা সেতু স্বপ্ন থেকে আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার সাহসের ফসল। তারপরও এই সেতুর নাম পদ্মা সেতু রাখাই যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সাহসের ফসল। বঙ্গবন্ধু যেমন আছেন আমাদের রক্ত পতাকায়। বাংলাদেশের পতাকায় আমরা সব সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। বাংলাদেশের প্রতিটি পথে-প্রান্তরে, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে আমরা বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই, যেমনটা বাংলাদেশের সব পথ আজ মিশেছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়ায়। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিনই বাংলার মানুষ দেখতে পাবে বঙ্গবন্ধুকে।
বাংলাদেশের এই যে অদম্য যাত্রা তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এক সময় চাঙা হয়ে ওঠেন; নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। তখন শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই নেতা-কর্মীরা কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করে।
স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কালো অন্ধকার গ্রাস করেছিল, সেই অন্ধকার তাড়াতে প্রথম আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকট- সীমাবদ্ধতার পর দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহু মুক্তির পালা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, বিকাশ এবং মুক্তির লক্ষ্যে অগ্রণী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য তার বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার সততা, নিষ্ঠা, যুক্তিবাদী মানসিকতা, দৃঢ় মনোবল, প্রজ্ঞা এবং অসাধারণ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্ব অঙ্গনে এক ভিন্ন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে । পিতার মতোই তিনি বিশ্ববিখ্যাত নেতা হিসেবে পরিচিত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরামহীনভাবে নিরন্তর জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার অদম্য শক্তি, সাহস, মনোবল এবং দঢ় নেতৃত্বে ‘বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়’। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হবে এবং ২০৪১ সালে একটি ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার বড় প্রমাণ হলেঅ গত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমান মাথাপিছু আয় ২,৮২৪। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কয়েকটি শীর্ষদেশগুলোর মধ্যে একটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন প্রথমটি হলো- ডিজিটাল বাংলাদেশ যা ইতোমধ্যে একটি পর্যায়ে এসেছে, দ্বিতীয়টি, ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা, তৃতীয়টি, ২০৪১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার এবং চতুর্থটি, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন।
গত চার দশকে তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার জন্য লড়াই করেছেন। সংগ্রামের এই গতিপথ ছিল প্রতিকূল। শেখ হাসিনা, যিনি অলৌকিকভাবে ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে গিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উনয়ন প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৩৯টি হাই-টেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মিত হচ্ছে।
কৃষি-শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আধুনিক প্রযুক্তি সবকিছুর অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে নতুন পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা করতে হবে। বাংলাদেশকে আমূল বদলে যাচ্ছে টেকসই উন্নয়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এদেশ। দুর্বল, অনুন্নত, নড়বড়ে অবস্থা থেকে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। প্রচলিত অবকাঠামোর আধুনিক রূপান্তর সম্ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করছে প্রতিদিন। যেসব খাত কিংবা ব্যবসা আগে অবহেলিত অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে চলছিল সেগুলোতে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অমিত সম্ভাবনার হাতছানি এদেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত, আগ্রহী করে তুলছে। অবহেলা-অযত্নে লালিত সেই সম্ভাবনাময় খাতগুলো ক্রমেই জেগে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ, দপ্তর, মন্ত্রণালয়গুলো সময়ে সময়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। ফলে সম্ভাবনার নতুন খাতের বিকাশ ঘটে চলেছে। সম্ভানাময় নতুন খাতগুলো বাংলাদেশের সমৃদ্ধি অর্জনে, অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মানুষ কোনোভাবেই অক্ষম-দুর্বল, মেধাহীন নয়। তারা অনেক পরিশ্রম করতে পারে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী-পুরুষ যারা এর আগে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আর অসহায়ত্বের বেড়াজালে নিজেদের বন্দি করে রেখেছিল, তারা এখন নিজের মেধা-বুদ্ধিমত্তা, শক্তি-সাহস, পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সম্ভাবনার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজেই নিজের ভাগ্য নতুনভাবে গড়ে তুলছেন। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকা, জনপদের চিত্র। সম্ভাবনার উজ্জ্বল চমক দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অবিশ্বাস্য রকমের। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪১তম স্থানে উঠে এসেছে।
এই পদ্মা সেতু যাতে না হতে পারে তার জন্য অনেকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছেন। বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গোটা জাতিকে হতাশায় ফেলে দেয়। কিন্তু সমগ্র জাতিকে অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করবেন। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যা। বাংলাদেশে যখন সংকট তীব্র হয়, যখন সবকিছু আবর্তিত হয় অনিশ্চয়তায়, বাংলার আকাশে কালো মেঘ জমে থাকে, তখন শেখ হাসিনাই আমাদের শেষ ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়ান। একজন ব্যক্তি অদম্য সংকল্প এবং কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে ভয়ের কালো মেঘকে সরিয়ে দেন, দেশের মানুষ আশার আলো দেখে। যখনই মনে হয় যে সবকিছু শেষ হয়ে আসছে, তখন আমরা খারাপ সময়টির মুখোমুখি হই, তবে একজন ত্রাণকর্তাই দক্ষতার সঙ্গে দুঃস্বপ্নটি সরিয়ে ফেলেন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
অতিভক্তি ভালো নয়। শেখ হাসিনাকে যারা ভালোবাসেন তারা কেন একটি স্থাপনার নামের মধ্যে তাকে সীমিত করতে চান। শেখ হাসিনা এখনও দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যতদিন বেঁচে থাকবেন মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, এটা তার প্রত্যয়। তার সামনে আরও অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে মানুষের জন্য আরও বৃহত্তর কল্যাণের পথ প্রশস্ত করার। তার কাছে মানুষের প্রত্যাশার ইতি ঘটেনি। তাই তাকে তার মতো চলতে দেয়াই ভালো। তার নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ করার প্রস্তাব তাকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দেয়ারই নামান্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের নামে পদ্মা সেতুর নাম চান না। এমনকি শেখ রেহানা চান না বলেও জানা গেছে।
গণতন্ত্রকে সুসংগঠিত করতে বাংলার পথ-প্রান্তর চষে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। গত ৫০ বছরে সবচেয়ে সৎ রাজনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। তিনি না ফিরলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না। জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান হয়েছে। নয়তো অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া সম্ভব হতো না। তিনি না থাকলে নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে পাথর বিছানো পথ, তাই সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেই সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষের সবচেয়ে বড় উপহার পদ্মা সেতু। এটি শুধু পদ্মা পারাপারের সেতুই নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস এমন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছে যে, আমরা যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারি। আর এই আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছেন আমাদের সময়ের সাহসী প্রধানমন্ত্রী। পিতা দিয়েছেন দেশের স্বাধীনতা আর কন্যা দিলেন সমৃদ্ধি, ঘর-বারান্দা চলাচলের পথ সাজিয়ে দিচ্ছেন। গ্রাম যাচ্ছে নাগরিক জীবনে।
তিনি সাহসিকতার সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা করছেন এখনও, এখন এটি বিশ্বের সেরা উদাহরণ এবং বিশ্ব নেতারা বিশ্বব্যাপী সংকট পরিচালনার জন্য তার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তার সাহসকে আরও অদম্য করে তুলেছে। নামকরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জোর দবরদস্তি করা ঠিক হবে না পদ্মা সেতু নদীর নামেই থাকুক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক