গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গত কয়েক বছর রাজনীতি, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ সক্রিয় ও আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই পরিচয়ে তাকে অনেকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি নিজেকে একজন ভাসানী অনুসারী দাবি করলেও তার সমর্থন ও দুর্বলতা ডান-বাম, উগ্র ডান, উগ্র বামসহ সব পন্থার ব্যক্তিদের প্রতি বাছ-বিচারহীনভাবে রয়েছে- এটি গোপনীয় নয়। তিনি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রতি যেমন আনুগত্য প্রকাশ করেন আবার বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে তিনি শ্রদ্ধা করেন বলে দাবি করেন। সামরিক শাসক এরশাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি তার অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। উগ্র সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক দল সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ শিকদারকে তিনি জাতীয় নেতার মর্যাদায় বসান। ১৯৭৬ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে ভারতবিরোধী জিগির তোলার লক্ষ্যে আয়োজিত ফারাক্কা লং মার্চকে এবারও পুনর্জীবন ঘটিয়ে নিজেই উগ্র ডান, উগ্র বামদের নিয়ে রাজশাহীতে লং মার্চ করে এসেছেন। সেখানেও তিনি ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে নিজেকে আলোচনায় রেখেছেন। তার রাজনৈতিক দর্শন মূলতই অতি ডান, অতি বামদের মাঝামাঝি অবস্থানে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাঙালি মধ্যবিত্তের তথাকথিত শিক্ষিতজনের রাজনীতি খুব বেশি একটা দেশপ্রেম ও আদর্শভিত্তিক নয় এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। এদের রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই সংকীর্ণ কিন্তু প্রকাশভঙ্গি উচ্চমার্গীয়। দেশ ও জাতির জন্য এদের দরদ ভালোবাসা দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। কিন্তু কালের স্রোতে এদের হারিয়ে যাওয়ার নজির এ দেশেই অনেক আছে। দেশ ও জাতি এদের থেকে শেষ পর্যন্ত কিছুই পায় না। এরা নিজেরা যেমন সফল হয় না, তেমনি দেশ ও জাতিকেও নানা বিভ্রান্তি ও দিকভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে রাখার বেশি কিছু অবদান রাখতে পারেনি। কারণ এদের তত্ত্বজ্ঞান অনেকটাই বায়বীয়, বাস্তবজ্ঞান একেবারেই শূন্য। ফলে এদের কাছ থেকে দেশ ও জাতি খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক দিকদর্শন পায় না। আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য এখানেই।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অনেক ভালো কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনের অজান্তে থাকা তার অনেক কথাই তিনি লুকাতে পারেন না। মুখ ফসকে বের হয়ে আসে। সেখানেই তার দ্বিচারিতার স্বরূপটি ধরা পড়ে যায়। তিনি নিজেকে যতই প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং দেশপ্রেমিক বলে মনে করেন; কিন্তু উগ্র ডান, বাম, হঠকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মিশেল দিয়ে কেউ কখনও দেশ ও জাতিকে উদারবাদী ধারায় অগ্রসর করার কথা ভাবতে পারেন না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রবীণ নাগরিক হিসেবে যখন বক্তব্য দেন তখন অনেকেই তার প্রতি সম্মান রেখে কথা বলেন । কিন্তু তিনি সেই সম্মানের অনেক কিছুই তার বক্তব্যের নির্মোহ বিশ্লেষণে থাকার মতো অবস্থানে না থাকলেও কেউ বিষয়গুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি বা ঘাটাঘাটি করে না। এখানেই তার বিশেষ সুবিধাটি। তবে তিনি যেসব স্ববিরোধী বক্তব্য ও আচরণ করেন সেটি বোধিচিত্তের মানুষদের না বোঝার কোনো কারণ নেই।
সম্প্রতি তিনি জাতীয় সরকারের একটি তত্ত্ব গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের ক্ষেত্রে কে বা কারা সহযোগিতা করেন তা আমাদের জানা নেই। তবে তার বিবৃতির মিশেল চরিত্র দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি হয় জনগণের দৃষ্টিকে তার মতো করে কিংবা অন্য কারো সুদূরপ্রসারী চিন্তাকে নিয়ে মানুষকে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার পরিকল্পনা থেকে এসব তত্ত্ব হাজির করেন। তবে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এক-দুইদিন এ নিয়ে কিছু আলোচনা- সমালোচনার পর নানা বৈপরীত্য, অসংগতি এবং চিন্তার বালখিল্যপনার কারণে সেটি আপনা থেকে উবে যেতে থাকে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যেভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন সেটি যে এত সহজ সরল নয়, তা তিনি কতটা জানেন বা বোঝেন জানি না। কিন্তু যে বিষয়ে তিনি এমন একটি প্রস্তাব হাজির করেছেন সেটি কোনো পক্ষই চিন্তার খোরাকের মধ্যে বিবেচনা করেছেন এমনটিও দেখা যায়নি। তবে নেপথ্যে থেকে যদি কেউ তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে থাকেন তারা হয়তো এখন বাজার যাচাই করছেন! ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব, কার্যকারিতা, সরকার কাঠামো ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।
দুবছরের জন্য দেশে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি যেসব বক্তব্য হাজির করেছেন তা এমন: “জাতীয় সরকারের প্রথম তিন মাসের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনি আইনের কিছু ধারার সংস্কার, গণভোট এবং ‘না’ ভোটের প্রচলন, প্রশ্নবিদ্ধ সংসদকে লক্ষ ভোটারের স্বাক্ষরে প্রত্যাহার ব্যবস্থা, জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিভাগে ন্যায়পাল নিয়োগ, প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ এবং ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি পুরোপুরি কার্যকর করে, ওষুধ, শৈল্য চিকিৎসা ও রোগনিরীক্ষার দর সরকার স্থির করে দেবে। পর্যাপ্ত লাভ দিয়েও ওষুধের সর্বোচ্চ বিক্রিমূল্য অর্ধেকে নেমে আসবে। অপ্রয়োজনীয় ও প্রতারণামূলক ওষুধ বাতিল হবে। সব ওষুধ কোম্পানিসমূহকে একাধিক কাঁচামাল উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়া হবে।” তার প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করেছেন, “মানহানির মামলা করতে হলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ন্যূনতম ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা কোর্ট ফি দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির শহরে ফৌজদারি মামলা করতে হবে। একই মামলা বিভিন্ন জেলার একাধিক আদালতে করা যাবে না।” প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, “পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক কর্মী ও আলেমদের জামিন নিশ্চিত করে এক বছরের মধ্যে তাদের বিচার শেষ করে রায় কার্যকর করা হবে।” প্রস্তাবে তিনি বাংলাদেশকে ১৫/১৭টি প্রদেশ বা স্টেটে বিভক্ত করার কথাও বলেছেন।
এক্ষেত্রেও তার প্রস্তাব, “প্রত্যেক প্রদেশে/স্টেটে ৬-৭ জন বিচারপতি সমন্বিত হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা এবং সুপ্রিম কোর্টে একটি সার্বক্ষণিক সাংবিধানিক বেঞ্চ সৃষ্টিসহ সুপ্রিম কোর্টে ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে-(১) ফৌজদারি, (২) দেওয়ানী, (৩) নির্বাচন ও মৌলিক অধিকার, (৪) কোম্পানি বিরোধ ও আয়কর সংক্রান্ত, (৫) সকল প্রকার দুর্নীতি বিষয়, (৬) যৌন নিপীড়ন ও নারীদের অধিকার ।” তিনি এই প্রস্তাবনায় ‘সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন, দুই কোটি মানুষের সাপ্তাহিক রেশনিং চালু করা, মাসিক ১০০ টাকায় তিন বাল্বের বিদ্যুৎ-সুবিধা এবং মাসিক ২০০ টাকার প্রিমিয়ামে ওষুধসহ সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিচর্যা, দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ, অভিযুক্তদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, ভোটার তালিকা সংশোধন, দলের নিবন্ধন সহজীকরণ, দলীয় প্রতীকে ইউপি ও উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়া, পেশাজীবী, বয়োজ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, বাজেট প্রদান, বাজেটে শুল্কমুক্ত আমদানি, এনজিওদের মাধ্যমে কৃষিতে ৫ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ, কারাগার, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর হাসপাতালগুলো বিকল্প চিকিৎসাসেবা দ্বারা পরিচালিত, বিদেশফেরতদের বিমানবন্দরে ভিআইপি-সুবিধা, মৃতদেহ বিনা অর্থে দেশে আনা, প্রবাসীদের ৫০ লাখ টাকার জীবনবীমা-সুবিধা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করার ছয় মাস পর ক্ষমতা হস্তান্তর করা’ ইত্যাদি তার জাতীয় সরকারের রূপকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য তিনি ৩১ ব্যক্তির নাম তাদের বিনা অনুমতিতেই প্রকাশ করেছেন। এদের কেউ কেউ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তারা আদৌ এ ধরনের সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা দেশে অনুভব করেন কি না সেটিই মস্তবড় প্রশ্ন।তাছাড়া এখানে বিভিন্ন ঘরানার কিছু ব্যক্তিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দেয়ারও প্রস্তাব তিনি করেছেন। মন্ত্রণালয়ের নামও তিনি প্রস্তাব করেছেন। সমস্ত বিষয়টি তার একান্ত কাল্পনিক, একান্ত ব্যক্তিগত নাকি কারো কারো চিন্তাপ্রসূত প্রস্তাবনা সেটি একটি ভিন্ন প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো তিনি দেবেন না। কিন্তু যে প্রস্তাবনা তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেছেন সেটি পড়ে কোনো সচেতন মানুষ ভাবতে পারবেন না যে, এটি ইউটোপিয়া ছাড়া বাস্তবে কোনো চিন্তা করার যোগ্যতা রাখে।
দেশে সংবিধান আছে। এটিকে স্থগিত করার অধিকার কারো নেই। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিদের ছাড়া এক মুহূর্তের জন্য পরিচালিত হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। সে ধরনের চিন্তার পরিণতি আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অতীতে (১৯৭৫, ৮১-৮২, ৯০, ৯১, ৯৬, ২০০১, ২০০৬-২০০৮) যে বিপর্যয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নেমে এসেছিল সেটি কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারেন না। রাষ্ট্রক্ষমতায় নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত কেউ বসতে পারেন- সেই সুযোগ করে দেয়ার পরিণতি অনেক দেশের জন্যই বিপর্যয় ডেকে নিয়ে এসেছে।
সুতরাং জাতীয় সরকারের কথা শুনতে যত আবেগময় মনে হবে, কিন্তু বাস্তবে এর ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে জাতিকে রক্ষা করা খুবই কঠিন কাজ। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় জাতীয় বিপর্যয় চলছে তারপরও কেউই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের বাইরে গিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা কল্পনাও করছেন না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় সরকারের ঘাড়ে যেসব দায়িত্ব ন্যস্ত করতে চাচ্ছেন তা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা, সময় কোনোটিই তাদের হবে না।
দুইবছর দেশের সংবিধান কোথায় যাবে? ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন? যদি পারতেন তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা এবং বিষয়টি যথাযথ পরিবীক্ষণের চেয়ে বেশি কিছু ভাবাটাই অবান্তর। যা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা একমাত্র জনপ্রতিনিধিরাই রাখেন তাদের বাদ দিয়ে অনির্বাচিত বহু মত, বহু পথ, বহু চিন্তা ও ভাবাদর্শের মানুষদের সমন্বিত করে ভাববার কথা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাবেন কীভাবে? রাষ্ট্র, সরকার এবং সংবিধান নিয়ে হেলাফেলা করা যায় না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কবে এই উপলব্ধিতে ফিরে আসবেন?
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক