ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন নিয়ে কৌতূহল ছিল সবার। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের একক সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যাওয়ার পর ফরিদপুর আওয়ামী লীগে চাঞ্চল্য আসে। সেদিন জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বরাবরই চাঁছাছোলা কথা বলার জন্য খ্যাতি আছে ওবায়দুল কাদেরের।
আমার বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সমালোচকদের একজন ওবায়দুল কাদের। ঘোরতর শত্রুও তথ্যের অভাবে যে সমালোচনা করতে পারেন না, ওবায়দুল কাদের অবলীলায় সেটা করে ফেলেন। কারণ আওয়ামী লীগের ভালো-মন্দ দুটিই তার জানা। ওই সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ করে কোটি কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। তাদের দিকে নতুন নেতৃত্বকে লক্ষ রাখতে হবে। এর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতার দুদিনের মাথায় কলকাতায় ধরা পড়েন প্রশান্ত কুমার হালদার, যিনি পি কে হালদার নামেই পরিচিত। পরিচিত বলার চেয়ে কুখ্যাত বলাই ভালো। বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মেধাবী পি কে হালদার তার সমস্ত মেধা কাজে লাগিয়েছিলেন জালিয়াতির কাজে।
২০১৯ সালে দেশ ছেড়ে পালানোর আগে বছর পাঁচেকের মধ্যে অন্তত চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কৌশলে দখল এবং লুট করেছেন পি কে। ডাকাতিটা করেছেন সবার সামনেই। কিন্তু পিস্তল ঠেকিয়ে করেননি বলে, কেউ বুঝতে পারেননি। যখন জানাজানি হলো, ততক্ষণে পাখি হাওয়া। দুর্নীতি দমন কমিশন পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগে ৩৭টি মামলা করেছে। প্রাথমিক তদন্তে লুট এবং পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ওবায়দুল কাদের টাকা পাচারের কথা বলার দুদিনের মধ্যে একজন শীর্ষ পাচারকারীর গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই। এটা নিছকই কাকতাল ঘটনা। পি কে হালদার জালিয়াতিটা আওয়ামী লীগ আমলে করলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
আর্থিক খাতের নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে পি কে হালদার চুরি এবং পাচার করেছেন। পি কে হালদারের গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের জন্য একটা বড় বার্তা। আর সেটা হলো, টাকা পাচার করে তুমি বিশ্বের যেখানেই যাও, ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। তবে পি কে হালদার একাই টাকা পাচার করেননি। আওয়ামী লীগ সরকার বা দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন অনেকে যেমন টাকা পাচার করেছেন। আবার ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য সত্য হলে আওয়ামী লীগ করেও কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন অনেকে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের যে পরিমাণের কথা শুনি, তাতে দেশ-বিদেশে পি কে হালদারের মতো আরও অনেক পাচারকারী আছে।
বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক, খুঁজে খুঁজে তাদের সবাইকে ধরতে হবে। তাদের খুঁজে বের করতে সরকারকে গোয়েন্দা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে। মালয়েশিয়ায় কারা সেকেন্ড হোম বানিয়েছে, কানাডার বেগমপাড়ায় কাদের বাড়ি আছে সেই তালিকাটা যাচাই করলেই বেরিয়ে আসবে অনেকের নাম। পি কে হালদার না হয় ১০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। কিন্তু বা্ংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ তো লাখ কোটি টাকা। বাকি টাকা কারা পাচার করল, কোথায় করল, তারা কোথায়?
পাচারকারীদের গ্রেপ্তার, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পাচারের রাস্তাটা বন্ধ করতে হবে। হাজার কোটি টাকা তো নিশ্চয়ই কেউ লাগেজে করে নিয়ে যায়নি। সেটা কোনো না কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়েছে। একবার পাচার হলে সেই টাকা উদ্ধার করা অনেক জটিল প্রক্রিয়া। তাই দেশের স্বার্থে পাচার বন্ধ করাটা অনেক বেশি জরুরি।
ওবায়দুল কাদের যে এলাকার কথা বলেছেন, সেই ফরিদপুরে গণেশ উল্টে গেছে অনেক আগেই। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ঘনিষ্ঠ দুই ভাই রুবেল-বরকতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আগেই। সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ভাই বাবরকেও। তবে শুধু ফরিদপুর পরিষ্কার করলেই হবে না, সারা দেশের সব অর্থ পাচারকারীকেই ধরতে হবে। রুবেল-বরকত, বাবর-পি কে হালদাররাই তো শুধু অর্থ পাচার করেনি। সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, তারা অন্যায়কে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক