মানুষ হিসেবে একজন ব্যক্তি যে অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা লাভ করে তাই মানবাধিকার। যেকোনো ধরনের জুলুম, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মানবাধিকারের ধারণা বিকাশ লাভ করেছে। মানবাধিকার বর্তমানে বিশ্বমানবতা ও সভ্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকার। অবাধ ও মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকার মানবাধিকারের মূলকথা।
আমাদের দেশে ক্রমেই প্রতিবাদের অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে। যেকোনো অন্যায়, জুলুমের প্রতিবাদ করলেই মামলা ও পুলিশ দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদকারীকে শায়েস্তা করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তা না হলে গত ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার ১৭নং ওয়ার্ডের কলাবাগান এলাকায় তেঁতুলতলা মাঠ সংরক্ষণের আন্দোলনকারী নেত্রী সৈয়দা রত্না ও তার নাবালক ছেলে ঈশা আব্দুল্লাহ প্রীয়াংশুকে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ ধরে নিয়ে ১৩ ঘণ্টা থানা হাজতে আটকে রাখবে কেন? বেআইনিভাবে মুচলেকা নিয়ে ছেড়েইবা দেবে কেন?
সৈয়দা রত্না এমন কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটাননি। তিনি বড় কোনো জমায়েতের নেতৃত্বও দেননি। কোনো ধরনের লাঠি-সোঁটা বা অস্ত্র নিয়েও সেখানে তাণ্ডব সৃষ্টি করেননি। তিনি খেলার মাঠের বাইরে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘লাইভ স্ট্রিম’ করছিলেন মাত্র। সে সময় তার পাশে ছিল তার নাবালক পুত্র। এই সামান্য কারণে কি একজন নাগরিক ও তার শিশুপুত্রকে থানায় নিয়ে আটক রাখা যায়?
সৈয়দা রত্না কোনো অন্যায় দাবি নিয়েও সেখানে যাননি। তিনি অত্যন্ত যৌক্তিক একটি দাবি নিয়েই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। পান্থপথের উল্টো দিকের গলির পাশের খোলা জায়গাটিকে স্থানীয়রা চেনেন তেঁতুলতলা মাঠ নামে। ছোট একটু খোলা জায়গা। চারদিকে কয়েকটি রেইনট্রি ও মেহগনিগাছ।
একপাশে আবর্জনার ভাগাড়ও আছে সেখানে। জনাকীর্ণ নগরীর এই ছোট্ট মাঠে স্থানীয় শিশুরা খেলাধুলা করে। পাশাপাশি মাঠটিতে ঈদের নামাজ, জানাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান হয়। এই মাঠটিতে থানা নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ভুল কিছু করেননি। আর তিনি যে একা এই দাবি তুলেছেন, তেমনও নয়। ওই এলাকার কোনো মানুষই চায় না যে, সেখানে শিশুদের খেলার জায়গাটা উচ্ছেদ হোক, থানা নির্মাণ করা হোক। সৈয়দা রত্না এলাকাবাসীর সেই দাবির পক্ষে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র। সেই জন্যই কি তার প্রতি পুলিশের এই ক্ষোভ?
প্রশ্ন হলো, তেঁতুলতলা মাঠটিতেই কেন থানা নির্মাণ করতে হবে? ওই এলাকায় কি থানা নির্মাণের মতো আর কোনো বিকল্প জায়গা নেই? ওই মাঠে থানা নির্মাণের সিদ্ধান্তের শুরু থেকেই স্থানীয়রা প্রতিবাদ করে আসছে। ২০২০ সালে প্রথম যখন সেখানে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে থানার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয় তখন থেকেই এলাকার বাসিন্দারা সেই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করে।
তারা সাইনবোর্ড অপসারণ করে এবং আগের মতো জায়গাটি ব্যবহার করতে থাকে। এরপর ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় গত ৩১ জানুয়ারি থানা নির্মাণের জন্য খেলার মাঠের জমিটি ডিএমপির কাছে হস্তান্তর করে। তখন থেকেই পুলিশের সঙ্গে স্থানীয়দের বিরোধ শুরু হয়। সেদিন কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি দল মাঠ থেকে শিশুদের সরিয়ে কাঁটাতার দিয়ে জায়গাটি ঘিরে দেয়। সেখানে খেলতে যাওয়া কয়েকটি শিশুকে কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ। এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বাহিনীটির চার সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। তারপর থেকেই খেলার মাঠ রক্ষার জন্য এলাকার বাসিন্দারা সোচ্চার হয়ে ওঠে।
এ জায়গার প্রকৃত মালিক যিনি, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর আর দেশে ফেরেননি। পতিত জমি হিসেবেই এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রায় ৫০ বছর ধরে উন্মুক্ত এ স্থানটি ১৭ নং ওয়ার্ডের লক্ষাধিক বাসিন্দা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের কেন্দ্রস্থল এবং শিশুদের জন্য একমাত্র খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সেখানে কেন গায়ের জোরে থানা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হবে? এলাকাবাসীর মতামতের কি কোনো মূল্য নেই?
বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা খুব কম হয়নি। তারপরও সংশ্লিষ্টরা তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি। উল্টো প্রতিবাদকারীকে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া থানায় ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে নিজেদের ক্ষমতা ও দাপট দেখিয়েছে। এটা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। একজন নাগরিককে বিনা পরোয়ানায় তুলে নিয়ে আটকে রাখা যে বেআইনি, এটা কি পুলিশ জানে না? এটা শুধু অগণতান্ত্রিক নয়, স্পষ্টভাবে ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার। যা পুলিশ ও সরকারের ভাবমূর্তিকে কালিকালিপ্ত করেছে।
বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, এখানে সংবিধান কার্যকর আছে এবং নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে এমন একটা সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা ও প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সব নাগরিক, সংগঠন বা দলের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার। তাদের এ অধিকার হরণ করা, তাদের ওপর বল প্রয়োগ করা অন্যায়, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। এটা কোনো মতে, অভিপ্রেত নয়। সরকারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের বাড়াবাড়ির বিচার করতে হবে। থানা নির্মাণের বিষয়টিরও সুরাহা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, নাগরিকদের ক্ষেপিয়ে কখনও নিরাপদে দেশশাসন করা যায় না।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, এত কিছুর পরও সেখানে থানা ভবন নির্মাণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, সেখানে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে নির্মাণকর্মীরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই মাঠের পরিবর্তে কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো স্থান বেছে নেওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও কীভাবে থানা নির্মাণের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে? তাহলে কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথারও দাম থাকবে না?
এমনিতেই আমাদের মাঠ, খেলার জায়গা কম। বিভিন্ন ক্লাবের মাঠ যা আছে, তা সবার জন্য নয়। ধানমন্ডির শেখ জামাল মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষ ঢুকতেও পারে না। ছোট বাচ্চা যারা খেলতে চায়, তাদের জন্য সেভাবে কোনো জায়গা নেই। ঢাকাসহ দেশের সব শহরে শিশু-কিশোরদের পরিপূর্ণ বিকাশের উপযুক্ত মাঠ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্থান একেবারেই অপ্রতুল। আর রাজধানী থেকে তো মাঠ বা খোলা জায়গা হারিয়েই যেতে বসেছে। যতটুকু যা আছে, সেটুকু সংরক্ষণের পরিবর্তে যদি সেখানে থানা কিংবা অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়, তাহলে শিশুদের ভবিষ্যৎকে হত্যা করা হবে।
খেলার জায়গা না থাকার কারণে এখন শিশুরা বাইরে খেলার সুযোগ পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশু-কিশোর এবং যুবসমাজ খেলাধুলা ছেড়ে বাসায় বন্দি হয়ে সময় কাটায়। যার কারণে তারা ঝুঁকছে জঙ্গিবাদ এবং সাইবার আসক্তিতে। এমন বাস্তবতায় রাজধানীর খেলার মাঠগুলো উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা, সেগুলো সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, যেখানে যতটুকু খোলা জায়গা আছে, সেটাকে শিশুদের দৌড়-ঝাঁপের উপযোগী করে তোলার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর সরকার যদি মনে করে যে, খেলার মাঠের দরকার নেই, শিশুর বিকাশের মাধ্যমগুলো বিচিত্র ভবনের নিচে চাপা পড়ে যাক; আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মোবাইল, ল্যাপটপ, ভিডিও গেম, ফেসবুক আর পর্ন দেখেই সময় কাটাক− তাহলে অবশ্য বলার কিছু নেই!
লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা