খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন এক নাম, যিনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে গণতন্ত্র, আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছেন। তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল এক শোকস্তব্ধ মুহূর্তে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি একটি অস্থিরতা ও নেতৃত্ব সংকটের মুখে পড়ে। সে সময় একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ নয়, বরং দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তার হাতে গড়া আন্দোলন ও নেতৃত্বে বিএনপি ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি গণআন্দোলনের শক্তিতে, যার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের পর থেকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। মাত্র দুই বছরের মধ্যে, ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি পূর্ণাঙ্গ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সেই সময় সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশের রাজনীতিতে বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠনে, যা পরবর্তী সময়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে তার আপসহীন অবস্থান এবং দৃঢ় নেতৃত্ব তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে রাজনৈতিক অভিধানে অমর করে রাখে। আন্দোলনের সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন—১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে—কিন্তু প্রতিবারই তিনি দৃঢ়ভাবে রাজনীতির মঞ্চে ফিরে এসেছেন। সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল তার নেতৃত্বের পরীক্ষার আসল ক্ষেত্র। ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অবশেষে ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে। এরপরের ইতিহাস হলো বিএনপির অভ্যুদয়ের ইতিহাস। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়। এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করেনি, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে একটি নতুন গতিপথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালে, তখন দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে। তার নেতৃত্বে এ সময় দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা পায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৬ সালের পর রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং ২০০৭ সালের ১/১১ এর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিকভাবে হেয় করার চেষ্টা তার ও তার দলের জন্য নতুন সংকট তৈরি করে। এই সময় খালেদা জিয়াকে দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়, যা তার রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ক্ষমতায় থাকার সময় বিএনপির ওপর শুরু হয় তীব্র দমননীতি। হাজার হাজার মামলা, গ্রেপ্তার, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে এক অমানবিক সময়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনগুলোতেও উঠে আসে এই নিপীড়নের চিত্র। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও চালানো হয় প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা পরে হাইকোর্ট দশ বছরে উন্নীত করে। একই বছরের অক্টোবরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের সাজা ঘোষণা হয়। এর ফলে তিনি বন্দি অবস্থায় দীর্ঘদিন কারাগারে কাটান। পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি পরিত্যক্ত ভবনে তাকে রাখা হয়েছিল, যা ছিল মানসিক ও শারীরিক কষ্টকর অভিজ্ঞতা।
তার এই বন্দিত্ব শুধু একজন রাজনীতিকের নয়, বরং গণতন্ত্রের উপর আঘাত হিসেবে ধরা হয়। বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো মনে করত, এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ। দীর্ঘ কারাজীবনের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। তবে এই মুক্তি পূর্ণ স্বাধীনতা নয়; তিনি কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় গুলশানের ফিরোজায় থাকেন। শারীরিক অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নিতে না পারলেও, তার উপস্থিতি এবং রাজনৈতিক অবস্থান বিএনপিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
এই দীর্ঘ সময় তার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রাম, কারাবাস এবং গৃহবন্দিত্বে ভরা। কিন্তু খালেদা জিয়ার যে রাজনৈতিক পরিচয়, তা হলো আপসহীন গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব। তিনি কখনোই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আপস করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করেননি। বরং তার কারামুক্তি দিবস প্রতি বছর বিএনপি ও গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে হয়ে ওঠে এক প্রতীকী দিন, যা মনে করিয়ে দেয় রাজনীতিতে তার অবদান ও ত্যাগের কথা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এই মুক্তি কেবল তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ফেরানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক প্রতীকী ঘটনা। গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণে তার ভূমিকা নতুন করে আলোচনায় আসে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রতীক, যিনি নিপীড়ন, কারাবাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির মুখোমুখি হয়েও তার আদর্শ থেকে সরে আসেননি।
আজ যখন আমরা খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস স্মরণ করি, তখন কেবল একজন নেত্রীর মুক্তি উদযাপন করি না, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামী পথকেও স্মরণ করি। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পাল্টাতে হলে দৃঢ় নেতৃত্ব ও আপসহীন অবস্থানের প্রয়োজন। তার কারাবাস ও মুক্তির ইতিহাস আসলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসেরই অংশ।
বিএনপির জন্ম, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক দর্শন এবং খালেদা জিয়ার হাতে সেই দর্শনের বিকাশ আজও প্রাসঙ্গিক। তার নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে, গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, বরং সংগ্রাম, ত্যাগ এবং আপসহীনতার মাধ্যমেই তাকে এগিয়ে নিতে হয়। খালেদা জিয়ার কারামুক্তি দিবস তাই কেবল একটি তারিখ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়, যা নতুন প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই কখনো থেমে থাকে না।
রাজু আলীম, কবি, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব