বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এসসিও সম্মেলন ও তিয়ানজিন ঘোষণা

  • সম্পাদকীয়   
  • ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:২০

সাংহাই ফাইভ গ্রুপ - ১৯৯৬ সালে রাশিয়া, চীন কাজাকিস্থান, কিরগিজস্থান তুর্কেমেনিস্থানের সমন্বয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরাম। যে ফোরামের মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইউরেশিয়ান অঞ্চলের সীমান্ত নিরাপত্তা সুরক্ষা। এতদ উদ্দেশে ১০৯৭ সালে মস্কোতে ওই দেশের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে সংশ্লিষ্ট সীমান্তগুলো থেকে সামরিক শক্তি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৯০ পরবর্তী সমিকরণে সাংহাই ফাইভ গ্রুপের উদ্যোগটি রাশিয়া চীনের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপ অভিমুখী সম্প্রসারণ নীতির ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে ইউরেশিয়ান অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করে। এ পর্যায়ে রাশিয়া ও চীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি বহুমেরুভিত্তিক নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। মস্কো ও বেইজিংয়ের এই অঙ্গীকারের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার ধারনায় আসে গুণগত পরিবর্তন। ফলে ইউরেশিয়ান অঞ্চল, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুত্রপাত হয়। এ ধরনের নানা রাজনৈতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে ২০০১ সালে সাংহাই ফাইভ গ্রুপে যোগ দেয় উজনেকিস্থান। ফলে এটি সাংহাই সিক্স গ্রুপ হিসেবে পরিচিতি পায়। এ পর্যায়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আরও বিস্তৃত পরিসরে নেয়ার উদ্যোগ নেয় সদস্য দেশগুলো। উপরোক্ত ধারণাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০০১ সালের ১৫ জুন চীনের সাংহাইয়ে সাংহাই সিক্স গ্রুপের শীর্ষ নেতারা মিলিত হয়ে এসসিও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে জন্ম নেয় একটি নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন। যার নাম সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে এসসিও। পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান এবং ইরান ও বেলারুশ এই সংস্থায় যোগ দিলে এর সদস্য সংখ্যা দশে উন্নিত হয়। রাশিয়া ও চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় গঠনমূলক ভূমিকার উপযোগিতায় বিস্তৃত করা হয় এই ফোরামের পরিধি। এক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয় দেখা গেছে। ওই আলোকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে এসসিওকে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক জোট হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে সদস্য দেশগুলো। যেখানে রাশিয়া ও চীন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে রুশ চীন প্রস্তাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা বাস্তবায়নে এসসিও এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সর্বশেষ চীনে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের ফোকাস এ সংক্রান্ত স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। দুইদিন ব্যাপী এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের যুগপৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আশিতম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের সুবিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ ছিল পশ্চিমা বিশ্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো। এই দুই ইভেন্টে অংশ নিতে গত সপ্তাহে বেইজিংয়ে বিশ্ব নেতাদের ঢল নেমেছিল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং উন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও বেইজিংয়ে জড়ো হয়েছিলেন পশ্চিমা একাধিপত্যবাদের কড়া সমালোচক অনেক দেশের নেতারা। একইসঙ্গে ন্যাটো সদস্য তুরস্ক, ইইউ এর সদস্য স্লোভাকিয়া এবং ইউরোপের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ সার্বিয়ার নেতাদের অংশগ্রহণ এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। যা চীন ও রাশিয়ার প্রস্থাবিত বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাধারণভাবে এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য শুধুমাত্র এসসিও"র পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশগুলোর চিন্তা ভাবনার ওপর নির্দিষ্ট। তথাপি এসসিও সম্মেলন সমাপ্তীর মাত্র একদিন পরেই চীনের ভিক্টরি ডে প্যারেড অনুষ্টিত হওয়া, সেইসঙ্গে এসসিওর পর্যবেক্ষক সদস্য দেশ, সংলাপ অংশিদার সহ বহু দেশের রাষ্ট ও সরকার প্রধানের ব্যপক উপস্থিতির কারণে এবারের এসসিও শীর্ষ সম্মেলন আরও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে। বৈশ্বিক অস্থিরতার নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে অনুষ্ঠেয় এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতেই গত জুনে ইরানে ইসরায়েল মার্কিন যৌথ হামলার তীব্র নিন্দা জানায় সদস্য দেশগুলো। অন্যদিকে সম্মেলনের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে তিয়ানজিং ঘোষনাপত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্বক প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা রোধ, একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করা হয় তিয়ানজিন ঘোষনায়। একপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থায় বিদ্যমান উপরোক্ত প্রবণতাগুলো প্রতিরোধে একটি সমন্মিত নীতি গ্রহণের ব্যপারে সম্মত হয়েছে এসসিও। যা সদস্য দেশগুলোর আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের পথকে করবে সহজ। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় একটি সহজতর প্রক্রিয়া অনুসরণের পদ্ধতি প্রস্তুত করেছে এসসিও। যা শেষ পর্যন্ত গ্লোবাল সাউথের সমস্যা উত্তরণেও গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও গ্লোবাল সাউথের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিশেষ কিছু নীতি গ্রহণের ব্যাপারে এসসিও নেতারা আগে থেকেই একমত ছিলেন। গ্লোবাল সাউথকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর পর্যায়ে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ মুলক নীতি বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে রাশিয়া ও চীনের পূর্বতন চিন্তা ভাবনাগুলো এসসিওর মাধ্যমে সম্পন্ন করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবার। ফলে অর্থনৈতিক সাহায্যের আড়ালে গ্লোবাল সাউথের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার পশ্চিমা প্রচেষ্টাগুলোকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এমনটি হলে পশ্চিমাদের প্রভাব মুক্ত পরিবেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনায় স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডকে নানাভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই ফেলেছে এসসিও। আগামী দশ বছর ধরে এসসিওকে আরও উপযোগী করার অঙ্গিকার করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের মাধ্যমে মানবিক, রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ২০৩৫ সালের মধ্যে এসসিওকে পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রস্তুত করার কথা বলেছেন তিনি। এক্ষেত্রে চীনের প্রস্থাবিত আরেকটি ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ সফল হলে সেটি খুবই কার্যকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। চীনে এই সংস্থার শীর্ষ সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই উম্মুক্ত করেছে বৈশ্বিক পরিবর্তনের বহু পথ। যদিও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সামরিক লক্ষ্য কি সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। তথাপি এসসিওর সামরিক লক্ষকেই আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেননা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের আলোচনায় এসসিওকে মনে করা হয় ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী জোট হিসেবে। এ কথা সত্য হিসেবে ধরে নেয়ার অনেক কারণ আছে। বিশেষত গত দশকে এসসিও সদস্য দেশসমূহ নিয়মিতভাবে বেশ কয়েকটি যৌথ সামরিক মহড়া সম্পন্ন করেছিল। যেগুলো তখনকার প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সংবেদনশীল ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এসসিও এ ধরনের কর্মকাণ্ডের শিথিলতা লক্ষ্য করা গেলেও এই সংস্থার একটি বিস্তৃত সামরিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। যা তারা হয়তো আপাতত ফোকাস করতে চাইছেন না। এই অবস্থায় এসসিও এর কর্মকাণ্ড ঘিরে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বে । গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা, ইরান- ইসরায়েল যুদ্ধের আশঙ্কা, রুশ- ইউক্রেনীয় যুদ্ধের ভয়াবহতা সেইসঙ্গে এশিয়া প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চলে বিদ্যমান সামরিক উত্তেজনার আলোকে এসসিওর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেকে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত পশ্চিমি শক্তিগুলো অনেকটাই অপ্রস্তুত। যে কারণে সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাদের নয়া কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ন্যাটো রাশিয়া যুদ্ধের আশঙ্কার মধ্যে সংস্লিষ্ট ইস্যুতে এসসিও হঠাৎ কোনো যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভেস্তে দিতে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের সমস্ত পরিকল্পনা। একইকথা প্রযোজ্য ইরান ইসরায়েল যুদ্ধ, তাইওয়ান ও কোরিয় উপদ্বীপের ক্ষেত্রেও। এ ধরনের বাস্তবতার কারণে সাংহাই কো অপারেশন অর্গানাইজেশনই এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। চীনের সর্বশেষ সম্মেলন সাংহাই সহযোগীতা সংস্থার লক্ষ ও উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই আলোকে এটি খুবই পরিস্কার যে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর দূনিয়ায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো কিংবা অন্যান্য কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করার শক্তি অর্জন করেছে এসসিও। সময়ের পরিক্রমায় এসসিওর ভূমিকা সম্প্রসারিত হবে এটিই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। সদস্য দেশগুলোর সমন্বিত নীতির আলোকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করবে সাংহাই সহযোগীতা সংস্থা।

এসসিও সম্মেলন ও তিয়ানজিন ঘোষণা, হাসান জাবির, বিশ্লেষক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

এ বিভাগের আরো খবর