অনুবাদ:
(১০) তারা বলে, আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব, তখন কি আমাদেরকে আবার নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? আসলে তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতকেই অস্বীকার করে। (১১) ( হে নবী,) বলে দাও: তোমাদের জীবন হরণ করবে মৃত্যুর ফেরেশতা, যাকে তোমাদের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। (১২) তুমি যদি তাদের দেখতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে নতশিরে দণ্ডায়মান হবে! (তারা বলবে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শোনলাম। এখন আমাদেরকে (একবার দুনিয়াতে) পাঠিয়ে (সুযোগ) দিন, আমরা সৎকাজ করবো। আমরা (এখন) দৃঢ় বিশ্বাসী। (১৩) আমি চাইলেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে হিদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয়ই আমি জিন ও মানবজাতি উভয়ের দ্বারা জাহান্নাম ভরে দেব।’ (১৪) সুতরাং তোমরা যে এ দিবসের সাক্ষাত ভুলে গিয়েছিলে, তার স্বাদ গ্রহণ কর। আমিও তোমাদের ভুলে গেলাম এবং তোমাদের কর্মের দরুন অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাক।
মর্ম ও শিক্ষা-
ইতোপূর্বে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, তার কিতাব কোরআন এবং রিসালাতের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। তারপর এখানে আলোচ্য আয়াতগুলোতে ঈমানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। তা হলো কিয়ামত ও আখিরাত। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়, বরং এরপর সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। সবারই পুনরুত্থান হবে। কিয়ামত হবে, আখিরাত আছে। তখন প্রতিটি মানুষকে দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে।
বাতিলপন্থিদের আখিরাতে অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি-
অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিরা মনে করে, মৃত্যুর পর তারা যখন মাটিতে মিশে যাবে, তখন তাদেরকে আর পুনরুত্থিত করা হবে না তারা মনে করে, দুনিয়ার জীবনই শেষ। দুনিয়ার মৃত্যুই শেষ। এরপর আর পুনর্জীবন নেই। সুতরাং দুনিয়াতে তারা যে কর্মই করুক, সে ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে না। কোনো কিছুর হিসাব দিতে হবে না। এ জবাবদিহির চেতনা ও অনুভূতি না থাকার কারণে, তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে।
ফেরেশতাদের মাধ্যমে মানুষের জীবন হরণ-
সকল প্রাণীরই মৃত্যু আছে। নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছুই মারা যাবে, কিন্তু মানুষের মরণ এবং অন্যান্য প্রাণীর মরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান ও সম্মানিত সকল প্রাণীকে আল্লাহই প্রাণ দেন, কিন্তু শুধু মানুষের বেলায় বলা হয়েছে, আল্লাহ নিজের নিকট থেকে মানুষের জীবন সঞ্চার করেন। আর এখানে আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে, যখন মৃত্যুর সময় হবে তখন অন্য প্রাণীর মতো মানুষের প্রাণ বায়ু এমনিতে উড়ে যাবে না বরং ফেরেশতা এসে তার জান কবজ করবেন। আল্লাহর নিকট থেকে মানুষের প্রাণ সঞ্চার করার কথা বলে যেমন সম্মান দেয়া হয়েছে, তেমনি মৃত্যুর সময়ও মানুষের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাতেই মানুষের জান কবজ হবে।
কিয়ামতে পুনরুত্থান-
কিন্তু মৃত্যুই শেষ নয়। আয়াতে বলা হয়েছে, অতঃপর তোমাদেরকে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ মৃত্যু এলো, কবর দেয়া হলো, দিনে দিনে মানুষের লাশ পচে গলে মাটির সাথে মিশে গেলো, এটাই শেষ নয়। বরং এক নির্দিষ্ট সময়ে কিয়ামত আসবে। আল্লাহর নির্ধারিত ফেরেশতা সিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। সেই আওয়াজে কবর থেকে সকল মানুষ পুনরুজ্জীবিত হয়ে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে। সৃষ্টির প্রথম মানুষ থেকে শেষ মানুষ সবাই হাশরের মাঠে একত্রিত হবে। তা হবে অগণিত মানুষের বিরাট সমাবেশ।
কিয়ামতের দিনের হিসাব ও বিচার-
কিয়ামতের দিনের সেই বিরাট সমাবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। সেদিন সকল মানুষ আল্লাহর সম্মুখীন হবে, সবাই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব হবে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে)। উল্লেখ্য, মানুষকে শুধু আল্লাহর ইবাদতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এ উদ্দেশ্য পালনে সে কতটুকু স্বার্থক হলো, আর কতটুকু ব্যর্থ হলো, তার হিসাব দিতে হবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে কিয়ামতের মাঠে উপস্থিত হবে, সেদিন আল্লাহর বিচারের রায় তাদের পক্ষে যাবে। তারা মুক্তি পাবে এবং অনন্তকালের জান্নাতের শান্তির স্থান পাবে। যারা মানব জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তারা সেদিন কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বিচারের রায় তাদের বিপক্ষে যাবে। তারা অনন্তকালীণ শাস্তির দোযখে পতিত হবে।
সময় থাকতে শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত-
কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী ও বাতিলন্থীদের কি পরিণাম হবে, এখানে আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছেন। একথাও বলা হয়েছে, সময় ফুরিয়ে গেলে পরে আফসোসে কোন কাজ হবে না। শত আকুতি মিনতি করলেও লাভ হবে না। এখান থেকে আল্লাহ একথাটি বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, সময় থাকতে শুভ বুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত। সময় শেষ হয়ে গেলে কান্না কাটি করেও লাভ নেই। কাজেই দুনিয়ার জীবনে সত্যপথ গ্রহণ করা উচিত এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করা উচিত।
আখিরাতে বিশ্বাস, জবাবদিহিতা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা-
এখানে শুধু অবিশ্বাসী ও বাতিলপন্থিদের জন্যই শিক্ষা নয়, বরং সত্যপন্থি ও ঈমানদারদের জন্যও শিক্ষা রয়েছে। তা হলো এই যে, তারা যখন কিয়ামত ও আখিরাতের জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে, তখন তাদের উচিত আল্লাহর দেয়া জীবনাদর্শ ও জীবন-বিধানকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করা। অলসতায় গা ভাসিয়ে দেয়া ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, শুধু বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়, বরং বিশ্বাস অনুযায়ী আমল ও কর্ম হতে হবে। ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন চালালেই আখিরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে। তা না হলে মুক্তি পাওয়া কঠিন হবে। উল্লেখ্য, কারো যদি ঈমান থাকে এবং তার কর্ম ঈমানের দাবি অনুযায়ী না হয়, বরং বিচ্যুতি ও অপরাধই বেশি হয়, তাহলে তার শাস্তি হতে পারে। ঈমানের কারণে আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, কিন্তু অবহেলাজনিত অপরাধ থাকলে যদি ক্ষমা পাওয়া না যায় তাহলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে দোযখে শাস্তি ভোগ করার পর ঈমানের কারণে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া যাবে। কাজেই এ শাস্তি থেকেও আত্মরক্ষার জন্য ঈমানের দাবী অনুযায়ী জীবন যাপন করা উচিত।
সত্যগ্রহণে মানুষের স্বাধীনতা-
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে প্রত্যেককে হিদায়াত দিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। আর তা করেননি যৌক্তিক কারণে। আল্লাহ যদি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে হিদায়াত দিয়ে দিতেন, তাহলে সৎপথে চলার পুরস্কার এবং বাতিলের পথে চলার শাস্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ তখন কেউ বাতিলের পথে চলবে না। কাজেই শাস্তির প্রশ্নই উঠে না। আর যেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে সবাই সৎ পথে চলে, সেহেতু পুরস্কারেরও কোন অর্থ থাকে না। এজন্যই ফেরেশতাদের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি নেই। কারণ তারা বাধ্যতামূলকভাবেই আল্লাহর অনুগত। শুধু মানুষ ও জিন জাতিকেই মত ও পথ গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোন্ পথে চললে আল্লাহ খুশি হন তা কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। আর কোন্ পথে চললে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, তারও বর্ণনা রয়েছে তাতে। এছাড়া সত্য পথে চললে কি পুরস্কার রযেছে, আর বাতিলের উপর চললে কি শাস্তি রয়েছে, তাও বলে দেয়া হয়েছে। এসব বলে দেয়ার পর মানুষ ও জিন জাতিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তারা বুঝে-শুনে নিজ পথ বেছে নিতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের পূর্ণ স্বাধীনাত দেয়া হয়েছে।
কিয়ামতে অপরাধীদের প্রতি তিরস্কার-
কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসী, বাতিলপন্থী ও মুশরিকরা শুধু শাস্তিই পাবে না, বরং তাদেরকে তিরস্কার করা হবে। তারা দুনিয়াতে যেভাবে সত্যপন্থিদের প্রতি ঠাট্টা বিদ্রূপ করত, কিয়ামতের দিন তাদের প্রতি বিদ্রূপ করা হবে। যেমন তাদের বলা হবে, তোমরা তো আখিরাতকে ভুলে গিয়েছিলে, এখন মজা ভোগ করো। বলাবাহুল্য, শাস্তির মজা বা স্বাদ ভোগ করার কথা বলা বিদ্রূপাত্মক। শাস্তি কখনো মজা হতে পারে না।
আখিরাত অস্বীকার করাই বিপথে চলা ও শাস্তির মূল কারণ-
অবিশ্বাসী বাতিলপন্থিরা নবী, রাসূল, আল্লাহর কিতাব কোরআন, রাসূলের আদর্শ ও ইসলামী জীবনাদর্শের সবকিছুকেই অস্বীকার করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো আল্লাহর কাছে আখিরাতের জবাবদিহিতাকে অস্বীকার করা। এ বিষয়টিকেই এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। কারণ আখিরাত অস্বীকার করলে জবাবদিহিতার কোন ভয় থাকে না, শাস্তি বা পুরস্কারের প্রশ্ন উঠে না। সুতরাং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে, তাদের নিকট অন্যায় ও মন্দ পথ ছেড়ে ভালো পথে চলার কোন অনুপ্রেরণাই থাকে না। মন্দ পথে চললে যদি দুনিয়ার স্বাচ্ছন্দ ও শন্তি পাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য এটাই তো ভালো, কারণ আখিরাত তো নেই। কাজেই যারা আখিরাত অবিশ্বাস করে তারা তাদের পক্ষে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। অপরদিকে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে, এ বিশ্বাস তাদের সকল কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ যখন তারা কোন কাজ করতে চায়, তখনই তার বিবেক প্রশ্ন করে, এটা ভালো কি মন্দ। মন্দ হলে আখিরাতে জবাব দিতে হবে। এভাবে কিয়ামত ও আখিরাতে বিশ্বাস মানুষের আচার ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে।
ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক, সূরা সাজদাহ, পর্ব ৩