পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা-গুদাম থেকে সৃষ্ট অগ্নি-দুর্ঘটনা যেন ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার বাড়িতে বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম। ফলে কিছুদিন পর পরই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। এর সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত শুক্রবার দুপুরে লালবাগের বউবাজারে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পুরো কারখানাটিই আগুনে পুড়ে গেছে। তবে আগুন দিনের বেলা লাগার কারণে হতাহতের কোনো ঘটনা জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, কারখানাটি আবাসিক এলাকায়। চারপাশে বাসাবাড়ি ছিল। ভেতরে প্লাস্টিক মজুদ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মূলত, কিছু অপরিণামদর্শী মানুষের লোভের কারণে বার বার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছে এই এলাকার সাধারণ মানুষ।
এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১২৪ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদাম বিস্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছে আরও ৭১ জন। ঠিক একইভাবে কিছুদিন আগে আরমানিটোলায় মারা গেছে ৫ জন।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর পরই একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশকিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মামলা হয়নি। আবার দুএকটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি বিস্ফোরণের কারণ রাসায়নিক দ্রব্য অথবা দাহ্য পদার্থের গুদাম-কারখানা। অথচ, নিমতলীর মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাসায়নিকের গুদাম ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পটি আর এগোয়নি। তার পরিবর্তে বেশ দেরি করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক পল্লি স্থানান্তরে নতুন আরেকটি প্রকল্প নেয়া হয়। তবে সেখানেও অবকাঠামো নির্মাণকাজে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে।
বার বার অগ্নিকাণ্ডের মোটাদাগের একটি কারণ হচ্ছে, পুরান ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুদের জন্য ভাড়া দেন। এই কারখানা ও গুদামগুলোর বেশির ভাগেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর কিংবা ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র। অপরদিকে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও রাসায়নিক আমদানির অনুমোদন দিয়ে সেটা কোথায় রাখা হচ্ছে, কীভাবে রাখা হচ্ছে এর খোঁজ রাখে না। ব্যাপারটা এমন যে, অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ।
কোনো সংস্থা আবার লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রাখলেও অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। এই সব কিছুর ইক্যুয়েশন হচ্ছে, নিমতলী, চুড়িহাট্টা আর সোয়ারিঘাটের মতো ট্র্যাজেডিগুলো। কিছুদিন আগেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুদ রয়েছে, তা বৈরুত বন্দরে যেসব রাসায়নিক পদার্থ মজুদ ছিল তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইলসহ ভয়ংকর সব রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থগুলো সামান্য আগুনের স্পর্শে এলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বৈরুতে লোমহর্ষক বিস্ফোরণের পর বিপজ্জনক পদার্থ বা রাসায়নিক কারখানাগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক দেশ। অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিডনিতে মজুদ করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
ভারতও চেন্নাইয়ের ৭শ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। পুরান ঢাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপজ্জনক সব রাসায়নিক পদার্থের বিপুল মজুদ থাকলেও তা সরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। উল্লেখ্য, খননশিল্পে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া বোমা তৈরিতেও এই রাসায়নিক পদার্থটি বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটিকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মনুষ্য বসতির বাইরে সংরক্ষণ করতে হয়।
অপরদিকে, সার উৎপাদনেও আবার এই রাসায়নিক পদার্থটির ব্যবহার রয়েছে। তবে সার কারখানাগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাখা হয় কেবল পুরান ঢাকার বিভিন্ন গুদামে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, পুরান ঢাকার গুদামগুলোতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ড্রামভর্তি করে মজুদ করা হয় তেমনই অনেক গুদামে মজুদ থাকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন- যার সবই দাহ্য পদার্থ।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে বেশ কিছু রাসায়নিকের এক-একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী; যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। কারণ, এসব গুদামের কোনোটাতেই অগ্নিকাণ্ড নিরোধকের তেমন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্যবস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। কোনো ধরনের মনিটরিং ছাড়াই যেখানে সেখানে এসব এলাকায় রাখা হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য।
২০১০ সালে নিমতলীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে প্রাণঘাতী রাসায়নিক পদার্থের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেয়ার দাবি উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, পরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক শিল্পজোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেয়া এবং দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য আনা-নেয়া বন্ধসহ সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। পরিতাপের বিষয় হলো, এত বছরেও এখনও সরেনি একটি কারখানা। উলটো, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার সুযোগে অবৈধ রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছে দিনের পর দিন।
অপরদিকে, এমনও ঘটেছে যে, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ঠিকানায় ব্যবসার অনুমতি নিয়ে অনেকে পুরান ঢাকার ভেতরেই রাসায়নিকের মজুদ ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কাজকে নির্বিঘ্ন করতে তারা স্থানীয় প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবকেও কাজে লাগাচ্ছে। তাছাড়া, এই এলাকার রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত যেমন কার্যকর হচ্ছে না, তেমনই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন তাদের সমীহ করে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিলে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা আর গুদামগুলো অচিরেই স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা ঢাকার নিরাপত্তা বিধান সহজ করতে ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা আলাদা করতে বলছেন। তাই আরেক দফা বড় বিপর্যয়ের আগে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দিকনির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন- দ্রুত রাসায়নিক পল্লি চালু করার মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ, একটি অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভারও রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক