মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ‘ফসলি সন’ নামে। ধীরে ধীরে তা পরিচিত হয় ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতাকে ঘিরে। গ্রাম-গঞ্জ-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতেই পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন।
এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন ক্রেতাদের নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টিমুখ করাতেন। নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। প্রত্যাশা ছিল একটাই নতুন বছরে ব্যবসার পরিধি যেন আরও বাড়ে, বেচাকেনা ভালো হয়।
১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন ছায়ানট সংগঠকরা। শুরু হয় সীমিত আকারে বর্ষবরণ। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখের জাতীয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে।
আস্তে আস্তে তা সব ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় ও সর্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। এখন সারা দেশ এবং বাঙালি অধ্যুষিত বিদেশেও উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালি বাংলা নববর্ষে পথে নেমে পড়ে। নতুন জামাকাপড় পরে এক উজ্জ্বল সকালে তাদের আনন্দঘন উপস্থিতি বাঙালির অস্তিত্বের জানান দিয়ে আসছে।
এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই- কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির এক শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা পায়। একটি জাতিসত্তার নিজস্ব সংস্কৃতি যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে এটা তো কম পাওয়ার নয়। সত্যিই এটি অনেক গর্বের, অহংকারের। অর্থাৎ এই অর্জন উৎসবকে আরও গতিশীল করবে এমন প্রত্যাশা করা যায়।
আসলে তা কি হয়েছে? সব ধর্মের মানুষের সর্বজনীন জাতীয় এই উৎসব কি আগের মতো আছে? এক কথায় বললে মোটেই নেই। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর আক্রমণ ও ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে উৎসবের সর্বজনীন চরিত্র নষ্টের পাঁয়তারা চলছে। এ আঘাত ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর।
উগ্রবাদীরা দীর্ঘদিন থেকেই এই উৎসবকে টার্গেট করেছে। তাদের মাথায় চিন্তা পয়লা বৈশাখ ধর্মকে ছাপিয়ে সবাইকে একসূত্রে গেঁথেছে। তা হতে দেয়া যায় না। এতে ধর্ম রেখে মানুষ প্রগতির পথে হাঁটবে। যেকোনো মূল্যে তা রুখে দিতে হবে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন যারা দক্ষিণ এশিয়াসহ গোটা পৃথিবীতে ধর্মের নামে সন্ত্রাস করছে তাদের এজেন্টরাই প্রথম রমনায় পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায়।
এরপর আস্তে আস্তে এই উৎসব ‘নাজায়েজ’ বলে ফতোয়া দেয়। গান-বাজনা হারাম বলে ওয়াজ করে। মূল লক্ষ্য হলো পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে কথিত ধর্ম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সে লক্ষ্যে কিন্তু এখনও কাজ চলছে। এবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছে হেজাব নিয়ে বিতর্ক ও এ জাতীয় চেতনার প্রকাশ।
পয়লা বৈশাখের অসাম্প্রদায়িক এই উৎসব যে আন্তর্জাতিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর ভয়াবহ নীলনকশার শিকার এর বড় একটি বাস্তবতা কিন্তু এবারও দেখা গেছে। শুনেছি একাধিক দেশ বাংলাদেশ সরকারকে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হামলা হতে পারে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে হয়ত সেসব দেশ সতর্ক করেছে। তবে ঘটনাটি কতটুকু সত্যি তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এবারের পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এ তথ্য একেবারেই অমূলক নয়। তাছাড়া প্রতিবার বৈশাখের অনুষ্ঠান যেন সংকুচিত করা হয় বা করতে না দেয়া হয়- এজন্য সরকারের ওপর সাম্প্রদায়িক শক্তির সরাসরি চাপ থাকে।
এবারের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান নিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অপপ্রচার ও ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর দায়ে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। পুলিশের তথ্য বলছে, আসামির ফেক আইডিতে বলা হয় ‘পয়লা বৈশাখ পালন করা বিদাত। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গেলে খবর আছে। অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হতে পারে, এক সময় রমনা বটমূলের কথা সবার মনে আছে। নিজের জীবন বড় না পয়লা বৈশাখ বড়’- এমন নানা নেতিবাচক কথা লিখে উগ্র প্রচারণা চালিয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্র মতবাদপুষ্ট পোস্ট ও ভিডিও দেখে রেডিক্যালাইজড হয়ে ফেসবুকে ফেইক আইডি খুলে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ নামক ধর্মীয় উগ্র মতবাদী সংগঠনে যোগ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করে পোস্ট দেয় অভিযুক্ত।
এতসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি পাড়ি দিয়ে দু’বছর পর আবারও পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রমনা পার্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরেই রাজধানীতে বৈশাখের সবচেয়ে বড় আয়োজন।
কষ্টের কথা হলো- কঠোর নিরাপত্তার চাদরে এবারের ‘বাংলা নববর্ষ ১৪২৯’- এর মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ গত ১০ বছর আগেও এই পরিস্থিতি ছিল না। শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে টিএসসি-ভিসি বাংলো-সংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন মোড় ঘুরে আবার একই স্থানে গিয়ে এসে শেষ হয়!
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে এবার যারা যোগ দিয়েছেন নিশ্চয় নিরাপত্তার দিক থেকে অনেকটাই বেশি রকমের ভিন্নতা বা বাড়াবাড়ি সবাই লক্ষ করেছেন। উৎসবকে কেন্দ্র করে রমনার পুরো এলাকায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনি গড়ে তোলা হয়। অথচ বাংলা বর্ষবরণে বাঙালির নানা আয়োজনের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্যতম।
আগের দিন রাত থেকে শাহবাগ-দোয়েল চত্বর-কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার-নীলক্ষেতসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে যত প্রবেশপথ রয়েছে সেগুলো কাঁটাতার দিয়ে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথ দিয়ে মানুষের যাতায়াত স্বাভাবিক ছিল না। মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর আগেই দেখেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি। শোভাযাত্রা শুরুর পর সামনে র্যাবের মোটরসাইকেল টহল, এরপর পুলিশ-সোয়াতসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন।
এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই এবারের র্যালিটি সীমাবদ্ধ ছিল। যদি হাতেগোনা যেত তাহলে অংশগ্রহণকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি হতো। এরপর র্যালির ভেতরে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পারে রশি দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও দেখা গেছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এটি কি কোনো দেশবিরোধী শক্তির আয়োজন ছিল? নাকি নিষিদ্ধঘোষিত কোনো সংগঠনের কর্মসূচি? এ তো আমাদের প্রাণের উৎসব। তবে কি এই উৎসব নিষিদ্ধ করার চেষ্টার অংশ হিসেবে আগে থেকেই এমন মহড়া চলছে।
যদি তা না হয় তবে এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতি কেন? আমরা তো অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। বাঙালির ঐতিহ্য আমাদের অহংকার। তাই ‘নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’- এ আহ্বানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। যেখানে সবার মঙ্গলের কথা বলা হচ্ছে, সেই উৎসব কেন চাপিয়ে রাখা হবে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে? যতই সাম্প্রদায়িক শক্তি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলুক এখনও বিশ্বাস করি দেশের বেশিরভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। তারা কখনই দেশবিরোধী-সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনের কাছে মাথা নত করবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক