জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো নেতার জন্ম না হলে যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো কি না বলা মুশকিল, তেমনি লি কুয়ানের মতো একজন নেতা না পেলে সিঙ্গাপুরও আজ এতটা উন্নতি করতে পারত কি না সন্দেহ। লি ছিলেন সব অর্থেই ব্যতিক্রমী মানুষ। মেধাবী, দূরদর্শী এবং প্রতিভাবান। তিনি শুধু কাছেরটা দেখতেন না, অনেক দূরেরটা নিয়েও ভাবতেন।
১৯৭৪ সালে, সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র ৯ বছর পরে, একদিন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সুই সেনের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন। সুই সেন কথা প্রসঙ্গে লিকে বলেন, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পর তাকে হয়তো সরে দাঁড়াতে হতে পারে। কারণ তার বয়স বাড়ছে। তখন সুই সেনের বয়স ছিল ৬৫ বছর।
সুইর সঙ্গে সেদিনের আলোচনা লিকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করেছিল। তারপর থেকে তিনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নির্বাচনের দিকে নজর দিতে থাকেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত কাজ ছিল শক্তিশালী উত্তরাধিকার গড়ে তোলা। মাও সে তুং এই সমস্যা উত্তরণের জন্য উত্তরাধিকার বিকাশের স্বার্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ছত্রছায়ায় লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। আমাদের পক্ষে তেমনটা করা সম্ভব ছিল না। সঠিক চরিত্রের নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদেরকে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়েছিল, যারা সংকট মোকাবিলার মধ্য দিয়েই পরীক্ষিত নেতা হিসেবে বিকশিত হবে’।
লি কুয়ান লিখেছেন, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্বের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে নতুন রক্তের সঞ্চালন করা। এ প্রক্রিয়া চালু করার আগে আমার অনেক পুরাতন সহকর্মীকে পদ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। তারা তখন নিজেদের বয়স্কদের কাতারে ভাবতেন। নিজেকে প্রতিদিন আয়নাতে দেখে আমিও আমার অবস্থান বুঝতে পারতাম। আমাকে আমি আর আগের মতো সপ্রতিভ, ক্লান্তিহীন এবং উদ্দীপ্ত ভাবতে পারতাম না। তারচেয়েও বড় কথা, প্রকাশিত প্রতিবেদন, ছবি ও ভিডিও-র প্রতি আমি আস্থাশীল ছিলাম এবং বয়সের ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম”।
নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার ধরন ও কৌশল কী বা কেমন হবে তা নিয়ে লি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নানা বাধা-বিপত্তিরও সম্মুখীন হয়েছিলেন। তার পুরাতন বয়স্ক সহকর্মীরা মনে করতেন, তারা যেভাবে ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উঠে এসেছেন’ তাদের উত্তরসূরিদের সেভাবেই উঠে আসা দরকার। নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে পুরোনোদের কারো কারো অনীহা ছিল। কেউ কেউ মনে করতেন, নতুনদের এত সহজভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে দেয়াটা ঠিক হবে না, তাদের আরও শেখা উচিত এবং অপেক্ষা করা উচিত।
এক্ষেত্রে লি কুয়ানের মত ছিল ভিন্ন। তিনি তার মতো করেই সিঙ্গাপুর পরিচালনার জন্য পরবর্তী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। দেশ থেকে এবং বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারা পার্টিতে যোগদানের তিন-চার বছরের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করতেন। লি কুয়ান লিখেছেন, “আমি মনে করতাম নতুন জমানার মেধাবী ছেলেদের অপেক্ষা করার মতো অবকাশ নেই। পার্টিতে রাখতে হলে ওদের যথাযথ সুযোগ করে দিতে হবে। না হলে ওরা ওদের পছন্দের পথে চলে যাবে”।
এক কথায় বলা যায়, সিঙ্গাপুরের যোগ্য উত্তরসূরি প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে লি কুয়ান কিছুটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তবে উত্তরাধিকার নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতমকে খুঁজতে কড়া ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতেন।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি ও তার সরকার আস্থা রেখেছিলেন ‘ধান্ধাবাজিতে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু মেধাবী, আন্তরিক, কর্মদক্ষ এবং গতিশীল তরুণ’ কর্মকর্তাদের ওপর।
তিনি লিখেছেন- “নবনিযুক্তদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সাথে সম্পৃক্তার গুণাগুণ অর্জন করাটা ছিল অত্যাবশ্যক। যাদের ভেতর এ সমস্ত অতিরিক্ত গুণাবলি দেখা যেত, আমি শুধু তাদেরকেই মন্ত্রিসভায় স্থান করে দিতাম”।
লি কুয়ান নিজেও নতুনদের জন্য তার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। অবশ্য এরপরও তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। লি কুয়ান লিখছেন, “আমি ৩১ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম। ইচ্ছা করলে আরও এক টার্ম ওই পদে বহাল থাকতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার সক্ষমতা ও কার্যক্ষমতা প্রমাণ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই অর্জিত হতো না। অন্যদিকে, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমি যদি আমার উত্তরসূরিদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি তাহলে সেটা সিঙ্গাপুরের জন্য অধিকতর কল্যাণকর হবে। এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আর প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখিনি”।
লি কুয়ান স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেয়ার পর গো চক তং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন লি হিয়েন লুং। তিনি এখনও সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী। বলা প্রয়োজন যে, তিনি সাবেক ও প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী এবং আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউর ছেলে। সেজন্য অবশ্য সিঙ্গাপুরে ‘পারিবারিক’ শাসন চলছে বলে কেউ ‘অপবাদ’ দেন না। কারণ সেখানে সুশাসন আছে। আইন আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আইনের যথাযথ প্রয়োগ আছে। দুর্নীতি নেই, নেই স্বজনপ্রীতি। নেই কোনো ধরনের অপরাধ প্রবণতা।
একবার আমাদের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং অন্য সব দিক থেকে সিঙ্গাপুরের তুলনায় আমরা কত পিছিয়ে। না, ভুল বললাম, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং বিভেদের রাজনীতিতে আমরা এগিয়ে।
সুশাসনের অভাব এবং পরিবারতন্ত্র মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতির একটি সুন্দর দেশকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে। রাজাপাক্ষে পরিবারের কয়েকজন সদস্যের অপরিণামদর্শী শাসন ৩ হাজার ৮১৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নেতৃত্বের রাজনৈতিক সচেতনতা ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভাবে কী থেকে কী হওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে শ্রীলঙ্কা। আর তার বিপরীত দৃষ্টান্ত সিঙ্গাপুর। একটি ছোট্ট দেশ কত কিছুতেই আজ বিশ্বসেরা।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক