চার শ বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের নদীবেষ্টিত ও মনোরম পরিবেশের রাজধানী ঢাকায় এখন নাগরিক সংকটের শেষ নেই। ভালো সব কিছুর ইতিহাস ম্লান হয়ে অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহর। যখন উন্নত নগরীর আদলে ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে, তখন নতুন অনেক সমস্যা সামনে। কিংবা পুরোনো অনেক জঞ্জাল এখনও চলমান। বেশিরভাগ সমস্যাই মানুষের সৃষ্টি। অর্থাৎ নিজেরাই তিলে তিলে এই শহরকে ধ্বংস, আতঙ্ক আর সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছি।
প্রশ্ন হলো কত বিষয় সমাধান করলে সমস্যামুক্ত নগরী উপহার দেয়া সম্ভব? এর উত্তর কারো দেয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এতসব সমস্যার সমাধানও সত্যিই কঠিন। তবে কিছু সমস্যা সমাধান আসলেই সম্ভব। যার ফলে নগরবাসী নিরাপদ বোধ করে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে পারবে।
সহকর্মী বলছিলেন তার পরিবারের এক সদস্যের দীর্ঘদিনের কাশির কথা। বেশ কজন ডাক্তার দেখিয়েছেন তিনি। কাশির কারণ বের করা সম্ভব হয়নি। প্রায় তিন মাসের মাথায় শেষপর্যন্ত ডাক্তার বলেছেন, কাশি দূষণের কারণে এলার্জি থেকে। ধুলো-বালি-কালো ধোঁয়া আর দূষিত বাতাসে রোগটি শেষপর্যন্ত অ্যাজমাটিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। আরোগ্য লাভে এখন রোগীকে কোনো কাজ করতেও বারণ। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। একদিনের বেশি একটি কাপড় গায়ে দেয়া যাবে না। কোনো অবস্থাতেই ধুলো-বালি যেন নাক দিয়ে প্রবেশ না করে। এরকম রোগী এই শহরে কত সৃষ্টি হয়েছে তা কে জানে?
একের পর এক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জরিপে উঠে আসছে বাংলাদেশ দূষণের তালিকায় বিশ্বে প্রথম। আর শহরের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয়। বায়ুদূষণের পর এবার শব্দদূষণেও বিশ্বের শীর্ষস্থানটি দখল করেছে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রকাশ করা এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এর আগে একাধিকবার বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরের তালিকায় এক নম্বরে ওঠে আসে রাজধানী ঢাকার নাম। শব্দদূষণ নিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে শব্দদূষণ কীভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে, সে বিষয়েও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ শহরের তিনটির অবস্থানই দক্ষিণ এশিয়ায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন বা নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের জন্য ঘরের ভেতর শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।
শব্দদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, উড়োজাহাজ, ট্রেন, শিল্পকারখানা ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট শব্দ। এসব শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপদে ফেলে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এর আগেও এসব সমস্যা নিয়ে দেশে বার বার আলোচনা হচ্ছে। সংকট সমাধানে বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত তুলে ধরছেন। কিন্তু সংকট যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়েছে।
স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেল বা তার বেশি হলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, উচ্চশব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে একজন মানুষের শ্রবণশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উচ্চশব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আদতে তাই হচ্ছে। কিন্তু সবকিছুতেই আমরা যেন একেবারেই নির্বিকার।
এখানেই শেষ নয়, শব্দদূষণে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। উচ্চশব্দে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষভাবে ক্ষতি হতে পারে শিশুদের। দিনের পর দিন শব্দদূষণের শিকার শিশুদের মনোযোগ দেয়ার ও কিছু পড়ার ক্ষমতা লোপ পেতে পারে।
বায়ুদূষণের আরেকটি বড় কারণ হলো ধূলিকণা। রাজধানী ঢাকা যেন গেল কয়েক বছর ধরে কুয়াশার শহর। তবে এই কুয়াশা শীতের নয়, ধুলোর। পৌষ-মাঘ মাসে এই শহরে রমনা পার্ক ও লেক এলাকা ছাড়া খুব একটা কুয়াশা দেখা যায় না। যেখানে দেখা যায় তাও অল্প সময়ের জন্য। কেউ দেখে। কেউ দেখে না।
২০০৬ সাল থেকে সরকারের করা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে। বিধিমালা অনুযায়ী শব্দদূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। তা যথাযথ কার্যকর করার তো কোনো উদ্যোগ নেই। বিধি বেশিরভাগ কাগজেপত্রেই সীমাবদ্ধ!
ঘরের ভেতর থেকে রাস্তা ছাপিয়ে অফিস পর্যন্ত এই শহরে শুধু প্রতিকূল চিত্র। বাসা বাড়িতে বছরজুড়ে মশার উপদ্রব। এতসব আলোচনার পর মশার উপদ্রব থামানো যায়নি। সুপেয় পানির অভাব এটা তো কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কারণ পানির অপর নাম জীবন। তবে কেন একটি শহরে সুপেয় পানির অভাব থাকবে?
বর্ষার আগমনি বার্তার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এবারও তাই শোনা যাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল একটি বড় সমস্যা। পৃথিবির অন্যান্য দেশে খাদ্যে ভেজালকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভেজাল ও মানহীন খাদ্যের কারণে এখন কলেরা হাসপাতালে রোগী ধারণের জায়গা নেই।
যে ভবনে বাস করি এই ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত কি না, অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কি না সে প্রশ্ন তো রয়েই গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য পানি ও গ্যাসের সমস্যা তো আছেই। কখনও কম, কখনও বেশি। শিশুদের খেলাধুলার জায়গা নেই। নেই মুক্ত বাতাস। গরমের দিনে হাসফাস নাগরিক জীবন।
বাড়ি কিংবা অফিসে আগুন লাগার ঝুঁকি পায়ে পায়ে। ভবন নির্মাণে অনুমোদন দেয়া হলেও দুর্ঘটনার সময় ভবনে থাকা নাগরিকদের উদ্ধারে নেই আধুনিক সরঞ্জাম। অথচ একের পর এক সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েই যেন খালাস রাজউকসহ অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঘর থেকে বের হওয়ামাত্রই পাওয়া যায় অপরিকল্পিত সরু গলি। অলি-গলিতে দেদারসে নির্মিত হচ্ছে নতুন ভবন। এক ভবন থেকে আরেক ভবনের দূরত্ব মানা হচ্ছে কি না তাও দেখভালের যেন কেউ নেই! মূল সড়কে প্রবেশ করামাত্রই শব্দের ভয়াবহতা। দুর্বিষহ যানজট। সড়ক দুর্ঘটনার বীভৎসতা। রাস্তায় বের হওয়া মানেই আতঙ্ক। দিনের পর দিন এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেও সমাধানের আলো নেই।
দিনে ৪৬টি নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া এই শহরে এখন বৈধ যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। সেসঙ্গে ইচ্ছেমতো বেপরোয়া পথচারীর সড়ক পারাপার। সড়কে বেপরোয়া যান, যেকোনো সময় যে কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।
যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়, মুক্ত জায়গায় মলমূত্র ত্যাগে পরিবেশ দূষণ। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে পোস্টার। গোটা শহর যেন পোস্টারের নগরী। এ নিয়ে কি কোনো আইন নেই? থাকলেও তা মানুষ জানে না। দোষীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থাও।
বছরের পর বছর রাস্তা উঁচু করাতে অনেক এলাকার বাড়ি নিচু হয়ে যাওয়ায় ভবন মালিকদের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এর প্রতিকার হয়ত কোনোদিনই মিলবে না।
পুলিশের হিসাবে এই শহরে চলতে পারে তিন লাখ গাড়ি। তবে বাড়তি যানবাহন কেন রেজিস্ট্রেশন দেয়া হলো এর জবাব কে চাইবে? বা উত্তরইবা কে দেবে?
ফুটপাত দখল। ২৫ ভাগ সড়কের মধ্যে আটভাগ যা-ও আছে এরমধ্যে অর্ধেক দখলে। আইন না মানার প্রবণতা সবখানেই। রাজধানীর আশপাশের ইটভাটাগুলো এক দশকেও বন্ধ করা যায়নি। ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব কোনোভাবেই কমিয়ে আনা যাচ্ছে না।
ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকার পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আছে দীর্ঘদিনের তারের জঞ্জাল। নেই জলাশয়। ভরাট হয়ে গেছে পুকুর-ডোবা। হারিয়ে গেছে বেশিরভাগ খাল। আসন্ন বর্ষা মৌসুমেও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ নগরবাসীকে পোহাতে হবে- এটাই যেন নিয়তি। অথচ ইচ্ছা করলেই কিন্তু আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক করে আনা অসম্ভব নয়।
সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা আজকের নয়। এতসব সমালোচনার মধ্যেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। বছরজুড়ে চলে রাস্তায় কাঁটাছেঁড়া আর খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি। সরাসরি মানুষের উপকার হয় এমন চিন্তা মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত।
উন্নয়ন প্রকল্প চলমান অবস্থায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে নাগরিক ভোগান্তি কমানো ও পরিবেশ সুরক্ষার। ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থা আরও আধুনিকায়ন করা দরকার। ময়লা পানি গড়িয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, পরিবেশদূষণ যেন না হয়। যেন ম্যাননহোলের ঢাকনা খোলা না থাকে। বার বার ফুটপাত ভাঙাগড়ার খেলা আর কতদিন চলবে? কেউ জানে না।
রাজধানী শহরের অবস্থান চারটি নদী ঘিরে। বলা হয় নদীবেষ্টিত শহরের মানুষ ভাগ্যবান। অথচ বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গাসহ চারটি নদী এখন ঢাকার দুঃখ। নদীখেকো ও ভূমিদস্যুদের থাবা থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না নদীর জমি, পানি। শিল্প মালিকরা ইচ্ছামতো বিষাক্ত বর্জ্য ফেলছে নদীর বুকে। বিলীন হতে চলেছে নদীর মাছ, জীববৈচিত্র্য। স্বচ্ছ পানি রূপ নিয়েছে আলকাতরার রঙে।
একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম ৮৫ দিনে রাজধানীতে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে! ৫০ থানায় মামলা হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। মীরপুরের কাজীপাড়ায় গরিবের ডাক্তার হিসেবে খ্যাত বুলবুলকেও রাস্তায় ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যাকারীদের গুলিতে প্রাণ গেছে নিরীহ কলেজছাত্রী প্রীতির। বেড়েছে ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। ব্যক্তিগত বিরোধে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। সব মিলিয়ে সবার নিরাপত্তা ভীতিও রয়েছে নগরীতে। গণপরিবহনের ভোগান্তি তো আছেই। বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। লাফিয়ে বাড়ছে বাসা ভাড়া। আয় কমছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের।
সব মিলিয়ে রাজধানীর মানুষের সমস্যা অন্তহীন। তবে সব কিছু অল্প সময়ে চাইলেই সমাধান হয়ে যাবে, এমন ধারণাও অমূলক। প্রয়োজন একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। আগে সব রকমের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথে যাওয়া উচিত। এজন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
মনে রাখা জরুরি সব সমস্যার সরাসরি প্রভাব কিন্তু পড়ে মানুষের উপর। শুধু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই নাগরিক সব সংকটের সমাধান মিলবে না। একে একে ছোটখাট সব সমস্যা সমাধানে হাত দিতে হবে। ছোট সমস্যাগুলো মানুষকে কত ভোগান্তি দেয় এ চিন্তা করা উচিত। অন্যথায় চলমান বাস্তবতায় মেগাসিটি ঢাকা কিন্তু এক সময় আন্তর্জাতিক জরিপে মৃত নগরীতে রূপ নিতে পারে। তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বা সুনাগরিক হিসেবে কেউ তা চাইবে না। ‘ঢাকা বসবাসের নগরী’ এমন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক