বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জীবন বন্ধক দিয়ে চলতে হবে?

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৭ মার্চ, ২০২২ ১৫:৩৬

সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি করবে, নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একে অপরকে খুন করবে, আর তাদের গোলাগুলির শিকার হয়ে নিরীহ মানুষ নিহত হবে, এই ধারা আর কতদিন দেখতে হবে? রাজনৈতিক দলগুলো কবে দল থেকে সন্ত্রাসীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে?

‘মন ভাল নেই, মন ভাল নেই, মন ভাল নেই।

কেউ তা বোঝে না, সকলই গোপন, মুখে ছায়া নেই।

চোখ খোলা, তবু চোখ বুজে আছি...’

কবির এই পঙ্‌ক্তিগুলো আজ মনে পড়ছে খুব। মনটা সত্যিই ভালো নেই। বিনা অপরাধে, কেবল সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলির কারণে প্রাণ দিতে হলো সামিয়া আফরিন প্রীতি নামের একটা সম্ভাবনাময় মেয়েকে। যার অনেক স্বপ্ন ছিল রোজগার করবে, বাবার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ঘাতকের বুলেট সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দিল না। এমনকি মেয়েটি জানতেও পারল না কেন তাকে জীবন দিতে হলো। কেন তাকে গুলিবিদ্ধ হতে হলো!

এ এক আজব দেশে আমরা বাস করছি। একদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে, নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরপূর্তি পালন করা হচ্ছে। নেতানেত্রীদের বক্তৃতায় দেশের উন্নতি-অগ্রগতির খতিয়ান উচ্চস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে। অথচ ব্যস্ত রাস্তায় অকারণে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে একজন নিরীহ নারীকে। কারা তাকে হত্যা করল, কেন তাকে জীবন দিতে হলো౼ এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না। কেন এমনটা ঘটছে? কেন একজন নাগরিকের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই? তাহলে কি অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে আমাদের জীবনকে বন্ধক দিয়ে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে হবে? কোথায় পুলিশ, কোথায় গোয়েন্দা? কোথায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা? সামিয়া আফরিন প্রীতির মৃত্যুর দায় কে নেবে?

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রীতি দুর্বৃত্তদের টার্গেট ছিল না। যানজটে সড়কে আটকা পড়ে রিকশায় বসে ছিল। সেখানে টার্গেট ছিলেন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। দুর্বৃত্তরা তাকে তো খুন করতে গুলি ছুড়েছে। তাদের এলাপাতাড়ি গুলিতে পাশের রিকশায় থাকা প্রীতিও নিহত হয়েছে।

এ ঘটনায় মনে পড়ে যায় সনির কথা। ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শোকে, বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যায় সমগ্র বাংলাদেশ।

প্রশ্ন হলো, সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি করবে, নিজেদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একে অপরকে খুন করবে, আর তাদের গোলাগুলির শিকার হয়ে নিরীহ মানুষ নিহত হবে, এই ধারা আর কতদিন দেখতে হবে? রাজনৈতিক দলগুলো কবে দল থেকে সন্ত্রাসীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে? কবে দেশ ও দেশের রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে? আর এই সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র কোথা থেকে আসে? কারা এসব অস্ত্র সরবরাহ করে? পুলিশ তাদের ধরতে পারে না কেন? যাদের জেলে থাকার কথা, তারা রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ পায় কীভাবে? দুর্বৃত্তলালন ও তোষণের রাজনীতি আর কতদিন চলবে?

দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সত্যি হতাশ হতে হয়। কোথাও কোনো নিয়ম নেই, নীতি নেই, শৃঙ্খলা নেই। এতে করে সাধারণ নাগরিক এক দুর্বিষহ হতাশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে, ছাইচাপা আগুন বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন।

প্রীতির বাবা মো. জামাল উদ্দিন বলেছেন, ‘আমার মাইয়াটা বিনা কারণে মইরা গেল! কোনো দোষ ছিল না তার। নিয়তি মাইয়াটারে কেড়ে নিল। একজনের জন্য (নিহত আওয়ামী লীগ নেতা) আরেকজনের খেসারত। এইটা কেমন বিচার! আমার মাইয়াটার মতো এমনটা যেন আর কারো না ঘটে।’

উল্লিখিত ঘটনায় তিনি কোনো মামলা করবেন না বলেও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব?’

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ‘বিচার চাই না’౼এই ধরনের ক্ষোভ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার নিষ্ঠুরতম নজির। আসলে প্রীতি যে ঘটনার বলি হয়েছেন, সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় চাঁইরা। বিচার চাইতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুনিরা প্রভাবশালী এবং সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে থাকে। এটা নিহতের পরিবার খুব ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই এখন আর কেউ মামলা করতে চায় না। পুরো দেশের একই পরিস্থিতি।

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আমাদের শাসন ও বিচার বিভাগের এমন একটা ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে যে, মা-বাবা তার সন্তান হত্যার বিচার পর্যন্ত চান না। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুবিচার নিশ্চিত করা। গত এক যুগের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায়। তারপরও কেন মানুষের এত আস্থাহীনতা? কেন হত্যা-মামলার বিচার হয় না? তনু, সাগর-রুনি, ত্বকী হত্যার বিচারকাজ কেন এগোচ্ছে না? কোথায় বাধা?

প্রীতির হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারেও যে এমনটা ঘটবে না, তার গ্যারান্টি কী! এই হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্তরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা। ক্ষমতাসীন দলের এই ‘সোনার ছেলেদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ বা প্রশাসন কতটা আগ্রহী হবে, সাহস দেখাবে? তবে সরকারের উচিত এ ব্যাপারে কোনো রকম পক্ষপাত না দেখানো। অপরাধীকে শনাক্ত করা এবং উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা। মনে রাখা দরকার, একজন বা কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ মানে, পুরো দলের বিরুদ্ধে নয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগেরও উচিত তদন্তে সহায়তা করা। এই খুনের ঘটনার প্রতিবাদ করা। অপরাধ, অপরাধী, আর দলকে গুলিয়ে না ফেলা।

ঘটনা ঘটার পর মন্ত্রীরা বলে থাকেন, দায়ী যেই হোক না কেন সে খুনি এবং শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এই ধরনের কথাগুলোকে আজকাল আর কেউ তেমন গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে না। কেননা এই ধরনের কথার কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। কদিনের উত্তপ্ত বাগ্-বিতণ্ডার পর সব ধামাচাপা পড়ে যাবে, জনগণের দাবির স্বর সন্ধ্যা প্রদীপের মতো স্তিমিত হয়ে আসবে।

তনু হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু অভিযুক্তরা অনেক বেশি প্রভাবশালী বলে তেমন ফল ফলেনি। তুলনায় প্রীতি হত্যার প্রতিবাদ এখনও জোরালো নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষকে ফুঁসে উঠতে হবে। সরব হতে হবে।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেবল কোনো গোষ্ঠী, দল বা পরিবারের জন্য সীমিত নয়। এই দেশ সবার। কেবল আমলা-ধনী, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের নয়। এখানে অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। অপরাধী তা সে যেই হোক না কেন, তাকে আইনে সোপর্দ করতে হবে। তা না হলে এটা পরিণত হবে বর্বরের দেশে। আমরা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো, কিন্তু খুনি-ধর্ষকদের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাব౼ সেটা কোনো সুস্থ প্রবণতা নয়। আর তাহলে শুধু তনু, ত্বকী, প্রীতি নয়, বাংলাদেশে কোনো সন্তানই নিরাপদ থাকবে না। কারণ অপরাধীর বিচার না হলে অপরাধ কেবলই বিস্তৃত হয়। এক সময় হতে পারে ‘‘পাপ’ ‘বাপ’কেও ছাড়ে না!”

মুনাফার লোভে, কর্তৃত্ব ও দখল কায়েমের নামে, ধর্মের নামে, নীতিহীন রাজনীতির নামে যারা মানুষের জীবন কেড়ে নেয় তাদের সংখ্যা নিতান্ত কম। তাদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যদি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে আক্রান্ত মানুষ একদিন ঠিকই ফুঁসে উঠবে। তখন খুনিদের রক্ষাকারী বা দোসর হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধেও জনরোষ উথলে উঠতে পারে। সেটা দেশের জন্য, সরকারের জন্য শুভ হবে না। কাজেই সময় থাকতেই সরকারকে অন্যায়কারী, মানুষ হত্যাকারীদের পক্ষ ত্যাগ করতে হবে।

লেখক: প্রবন্ধকার, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর