বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন ও গণহত্যার পরিকল্পনা

  •    
  • ২৫ মার্চ, ২০২২ ১৬:২৬

১৯৭১-এর জানুয়ারিতেই স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের চিত্র। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে উত্তাল হয়ে পড়ে প্রতিবাদী বাঙালি। মার্চের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। এমন গোলমেলে অবস্থা সামাল দিতে এবং নিজেদের গোপন চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার কথা প্রচার করে ঢাকায় আসেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে ধোঁয়াচ্ছন্ন করে দেয়ার অপচেষ্টা হয়েছে এদেশের নষ্ট রাজনীতির অঙ্গনে। প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার এসব অপচেষ্টা মাত্র। যতই পাথরচাপা দেয়া হোক না কেন ইতিহাসের সত্য মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবেই। ইতিহাসের এই সত্যের আঙিনা থেকে একটি খণ্ডচিত্র মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনের জন্য এই লেখাটির প্রয়াস।

১৯৭১-এর জানুয়ারিতেই স্পষ্ট হয়ে যায় পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের চিত্র। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে উত্তাল হয়ে পড়ে প্রতিবাদী বাঙালি। মার্চের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। এমন গোলমেলে অবস্থা সামাল দিতে এবং নিজেদের গোপন চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার কথা প্রচার করে ঢাকায় আসেন।

ঢাকাতে তাকে বাঙালিদের পক্ষ থেকে কোনো স্বাগত জানানো হয়নি। বিমনবন্দরের সব পথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। চারদিকে সৈন্যরা পাহারায় ছিল। প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল ১৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য। মেশিনগানে সজ্জিত গাড়ি ছিল। ঢাকাসফর সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানো হবে।’ ইয়াহিয়ার বিমান শ্রীলঙ্কা ঘুরে ঢাকায় পৌঁছে বিকেল ৩ টায়।

এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কতটা নাজুক ছিল তা পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেন-

“আমি অনেক রাষ্ট্রপতি আর দেশের প্রধানদের আগমন দেখেছি, কিন্তু ১৫ই মার্চ ঢাকায় যে, পরিবেশের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এসে অবতরণ করলেন তা আমি কখনই ভুলব না। বিমানবন্দরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। টার্মিনাল ভবনের ছাদের উপর স্টিলের হেলমেট পরা প্রহরীদের দাঁড় করানো হয়। বিমানবন্দর ভবনের প্রতিটি সদস্যকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। পিচঢালা পথে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা পিএএফ গেটে সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত একটা দলকে বসানো হয়। পদাতিক সৈন্যের (১৮ পাঞ্জাব) ট্রাকভর্তি একটি কোম্পানি (প্রায় ১০০ জনের) ফটকের বাইরে মেশিনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাষ্ট্রপতিকে সাথে করে শহরে নিয়ে যাবার জন্য। সতর্কতার সাথে বাছাই করা অল্প কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরের ভেতরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। তাদেরকে বিশেষ নিরাপত্তা পাস দেয়া হয়, আমাকেসহ।

কোনো ফুলের তোড়া ছিল না, ছিল না কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা, শহরের অভিজাতদের কেউ নেই, নেই সাংবাদিকদের ধাক্কাধাক্কি বা ক্যামেরার ক্লিক। এমনকি সরকারি ফটোগ্রাফারকেও অনুমতি দেয়া হয়নি। এ ছিল এক অদ্ভুত ভীতিকর পরিবেশ যেখানে জড়িয়ে ছিল মৃত্যুর স্তব্ধতা।”

১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন। এই বৈঠক প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে। এই দিনে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ একটি বিবৃতি প্রচার করে। বিবৃতিটি উদ্ধৃত করা হলো-

“পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তারা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, জোহা হল, মুন্নুজান হল, যশোর এবং রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার ফার্মগেট দ্বিতীয় রাজধানী ও কচুক্ষেত এলাকায় পাশবিক অত্যাচার চালায়। অনেক লোক খুন হয়েছে এবং স্ত্রীলোক পর্যন্ত ওদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে অবশ্যই এসব সৈন্য ফিরিয়ে নিতে হবে।”

এ সময় লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। বাঙালি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ডাক অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিল তার একটি চিত্র পাওয়া যায় পাকিস্তান গোয়েন্দাদের টেলিফোনে। সেখানে বলা হয়েছে- “প্রেসিডেন্টের পাচক ছিলেন একজন বাঙালি, নূরু মিয়া। সে অসহোযোগ আন্দোলনের ডাককে সমর্থন জানিয়ে প্রেসিডেন্টের খাবার তৈরি থেকে বিরত থাকে। ফলে প্রেসিডেন্ট শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে আছেন। জানতে পেরে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের জন্য রুটি ও বুটের ডালের ব্যবস্থা করেন (প্রণব সাহা, প্রামাণ্য চিত্র, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা)।”

এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বাঙালি অফিসারদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তারা পাকিস্তানি সেনাশাসকদের ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কিছুটা আঁচ করতে পারেন। পাশাপাশি গোপনে নিজেদের প্রস্তত করতে থাকেন। এই সেনা অফিসারদের অন্যতম চট্টগ্রামস্থ ইপিআর সদর দপ্তরের অ্যাডজুডেন্ট মেজর রফিকুল ইসলামের গ্রন্থে এসময়ের কিছু খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। তার বর্ণনা থেকে ১৭ মার্চের একটি চিত্র এখানে উদ্ধৃত করা হলো-

“...আমার একজন বিশ্বস্ত অফিসার ক্যাপ্টেন হারুন ছিলেন ইপিআর-১৭ উইং-এর সদর দফতর কাপ্তাইয়ে। আমি তাঁর সঙ্গে আলোচনা এবং করণীয় সম্পর্কে কিছু বলার জন্য মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাঁকে আমার বাসভবনে আসতে বললাম। আমি তাঁকে শেষবারের মত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেই মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখনই আমি তাঁকে গোপনীয় সাংকেতিক বার্তার অর্থ জানিয়ে দেই।

কাপ্তাই এলাকার সকল অপারেশনের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত ছিল এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী পরে চট্টগ্রামে আমার সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল। আমার সমর সদর দফতর করা হয়েছিল চট্টগ্রাম রেলওয়ে হিল এলাকায়।

১৭ মার্চ আমি চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর তরুণ বাঙালি অফিসারদেরকে পূর্বাপর ঘটনা এবং আমার প্রস্তাবিত কর্মপন্থা অবহিত করার জন্য সারসন রোডস্থ আমার বাসায় আমন্ত্রণ জানালাম।

সন্ধ্যার ঠিক পরে ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এবং লেফটেন্যান্ট শমনের মবিন বেবী ট্যাক্সিতে এলেন। সে সময় আমি আমার বাসার লনে পায়চারী করতে করতে কোন কথা দিয়ে কথা শুরু করবো এবং কি পরামর্শ দেবো সে সম্পর্কেই ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন হারুন, ডা. জাফর এবং জনাব কায়সারও এলেন। ডা. জাফরের সাথে আগেই কথা হয়েছিল যে, প্রথমে আমরা আমার বাসায় মিলিত হবো। তারপর যে যার পথে শহর থেকে ২০ মাইল দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান জনাব আলমের বাসায় গিয়ে পুনরায় মিলিত হবো। জনাব আলমকে একথা আগেই বলা ছিল। আমাদের বৈঠক সম্পর্কে পুরোপুরি গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই এরূপ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

আগত অফিসারদের আমি জানাই তাদের সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা আছে এবং আলম সাহেবের বাসায় গিয়ে তারা কথা বলতে রাজি কিনা। অফিসাররা সম্মতি জানালেন, তারপর ডা. জাফর, জনাব আতাউর রহমান কায়সার এবং আমি একটি গাড়ীতে আর ক্যাপ্টেন অলি, হারুন, খালেকুজ্জামান এবং মবিন ক্যাপ্টেন হারুনের ভক্সওয়াগনে জনাব আলমের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সেখানে এঁদের সাথে আমার প্রায় আধ ঘণ্টা কথা হলো। ডা. জাফর এবং জনাব কায়সার বাড়ীর চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন। আমি তাঁদেরকে বললাম, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য শক্তি সঞ্চয় করছে। প্রস্তুতি পূর্ণ হলেই তারা আঘাত হানবে। ওদেরকে আঘাত হানার জন্য আমরা তৈরী না হলে ওরা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে। এমতাবস্থায় আমাদের কি সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়া উচিত নয়? ওদের আগেই আমাদের আক্রমণ করা দরকার।

অফিসাররা আমার সাথে একমত হলেন। ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে অফিসাররা অবহিত দেখে আমি খুশী হলাম। আমি তাঁদেরকে বললাম, প্রায় ১৫০০ বাঙালী ইপিআর সেনা নিয়ে আমি প্রস্তুত রয়েছি এবং ঠিক সময়ে ওদের ওপর আঘাত হানবো। আমি মনে করি আপনারাও খবর পাবার সাথে সাথে আপনাদের সৈন্যদল নিয়ে আমার সাথে যোগ দেবেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যেহেতু ডা. জাফরের পক্ষে চিকিৎসক হিসাবে আমাদের সাথে যে-কোন সময় দেখা করা সম্ভব হবে এবং তাতে কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না। কাজেই তাঁর মাধ্যমে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। এরপর রাত সাড়ে দশটায় বৈঠক শেষ করে আমরা যার যার বাসায় ফিরে এলাম।

ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার তখন কার্যতঃ বন্দীদশা। বিরাট সশস্ত্র রক্ষীদল ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পূর্ব পাকিস্তানে তখন শেখ মুজিবের কিংবা তাঁর দলের নির্দেশ ছাড়া কিছুই চলছিল না, কোন কাজই হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলীই ছিলো তখন দেশের সর্বোচ্চ আইন। ইয়াহিয়া কর্তৃত্ব প্রহসনে পরিণত হয়েছিল (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তধারা, চতুর্থ প্রকাশ, ১৯৯১, পৃ. ৫৩-৫৪)।”

ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ মার্চে। ১ ঘণ্টাব্যাপী চলা বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আলোচনা চলবে।’ এতে অনেকে অনুমান করেন, আলোচনায় তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রতি মানুষের তেমন একটা আস্থা ছিল না। ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল এই বৈঠক ছিল ভুট্টো-ইয়াহিয়ার একটি সাজানো নাটক। সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে অগ্রগতি ঘটাতে চাইছেন, অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো দম্ভোক্তি করছেন যে তাকে ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা প্রতিহত করবেন।

এই দিনই ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। মূল অপারেশনাল পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের জন্য ১৮ মার্চ সকালে জিওসির কার্যালয়ে মেজর জেনারেল খাদিম রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি বৈঠকে বসেন। এসময়ই গণহত্যার পরিকল্পনা পাকা করা হয়।

লেখক: গবেষক-অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর