করোনার কারণে মানুষ বিপদে আছে। সেই বিপদ আরও বাড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। গত কয়েক বছরে গ্যাস-বিদ্যুৎ, পানির দাম দফায় দফায় বাড়ার কারণে সংসার খরচ এমনিতেই বেড়ে গেছে। তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে জ্বালানির মূল্য বাড়া। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবাড়াকে কারণ দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ায় সরকার।
গত সাড়ে তিন মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার এই বিরূপ প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারণ, এই মূল্য বাড়া শুধু জ্বালানি তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গণপরিবহনসহ বাজারের সব নিত্যপণ্যের ওপর গিয়ে পড়েছে। এই যখন অবস্থা, তখন আবার দেশের গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে খাতভেদে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ বা তারও বেশি হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের ওপর ২১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চার দিনের গণশুনানির আয়োজন করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যদিও বিইআরসির শুনানিতে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে। প্রশ্নের যথাযথ তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি তারা। উলটো তাদের প্রস্তাবিত খরচের হিসাবে গরমিল পেয়েছে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গ্যাসের মূল্যবাড়ার প্রস্তাব নিয়ে প্রথম দিনের শুনানিতে পেট্রোবাংলা প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাসের দাম ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করার প্রস্তাব দিলেও কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি যাচাই-বাছাই করে বলেছে, পেট্রোবাংলার খরচ হয় ১২ টাকা ৪৭ পয়সা। অন্যদিকে ক্যাব দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মত দিয়েছে। কারণ, সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রতি ইউনিটে পেট্রোবাংলার খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা ধরে একবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। গ্রাহকের কাছ থেকে গড়ে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা নেয়া হলেও বাকিটা জ্বালানি সুরক্ষা তহবিল ও সরকারি কোষাগার থেকে ভর্তুকি হিসেবে পেট্রোবাংলাকে দেয়া হয়। তাছাড়া, শুনানির একপর্যায়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেছেন, পেট্রোবাংলা সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা ছিল এবং এখনও তা আছে। কিন্তু মূল্যবাড়ার প্রস্তাবের পক্ষে পেট্রোবাংলার ব্যাখ্যা, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
পেট্রোবাংলার এবারের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, যেভাবেই হোক গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা। শুরুতে এই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আইন ও প্রবিধান অনুসারে উত্থাপিত না হওয়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) আমলে নেয়নি। কিন্তু পেট্রোবাংলা এতে দমে না গিয়ে নতুন করে আবারও আবেদন করিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে দিয়ে। সম্ভবত একেই বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কারণ, যখন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে, অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় রান্নার কাজ চলছে, পূর্ব ইউরোপীয় দুই দেশের যুদ্ধ বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে- তখনই দাম বাড়ানোর এই পাঁয়তারা শুরু হয়েছে।
অপরদিকে, গ্যাসের এই দাম বাড়ানোর তোড়জোড়ের আগেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ক্ষেত্রে তারা বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের পাইকারি দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। মানে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বাধ্য হয়ে বাড়াতে হবে। তদুপরি, সারও উৎপাদন করা হয় গ্যাস পুড়িয়ে। তাহলে ইক্যুয়েশন বলছে দাম বাড়বে সারেরও। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিতে। তাছাড়া এই মূল্য বাড়ার অজুহাতে আরও নানা রকমের অপ্রাসঙ্গিক মূল্য বাড়ারও যোগ হবে।
কিছুদিন আগে এমনিতেই ডিজেলের দাম বাড়াতে এক দফা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে হলো- তা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে আরেকটি বড় ধাক্কা আসা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই বাড়বে না, দেশের শিল্প-কারখানা তথা শিল্পক্ষেত্রেও পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব। এই মূল্যবাড়া উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা ধনিক শ্রেণির জীবনমানে তেমন প্রভাব ফেলবে না হয়তো; কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এমনিতেই অনেকে দূর্বিষহ জীবন যাপন করছে। কাজ হারানোদের বেশিরভাগই হয়তো নতুন করে কাজ পেয়েছে কিন্তু সমাজ অর্থনীতির সব পর্যায়ে এখনও অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র বিদ্যমান। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ার প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তার পরিবর্তে এই বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করাসহ সিস্টেম লস কমিয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে কীভাবে ভর্তুকির চাপ কমানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে।
কারণ, খোদ রাজধানীর অনেক এলাকাতেই বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা অনেক বেশি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদতেই এসব অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের কোনো বৈধ সংযোগ না থাকলেও এখানকার প্রতিটি ঘরেই জ্বলে গ্যাসের চুলা। কেবল বাসা নয়, বস্তির দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোতেও রয়েছে তিতাসের এই অবৈধ চুলার সংযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিতাসের লোকজনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই সংযোগ। শুধু কড়াইল বস্তি নয়, রাজধানী এবং এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ। এসব সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান করতে না পারলে গ্যাসের দাম বার বার বাড়িয়ে লাভ নেই।
গ্যাস নিয়ে যদি সংকট সৃষ্টি হয়-ই তবে মূল্য না বাড়িয়েও সংকট সমাধানের আরও পথ খোলা আছে। প্রথমত, দেশে নতুন যেসব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু উত্তোলন শুরু হয়নি সেগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া খনি ও কূপগুলোর আরও গভীরে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। একই সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের হাইপ্রেশার জোনগুলোতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কূপ খনন করা।
দ্বিতীয়ত, গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় কমিয়ে এনে রাজস্ব বাড়ানো। সরকার ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই সময়ে মাত্র ১০ শতাংশ বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করার পর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি পুনরায় চালু হয়েছে। এবার এক লাখ প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হবে। গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধে এই কার্যক্রমটিকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সবখানে প্রিপেইড মিটার চালু হলে কেবল সরকারের রাজস্বই বাড়বে না, গ্রাহকদেরও সাশ্রয় হবে।
বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতোমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দেশ দু’টির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় অর্জন। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে। সমুদ্রজয় তাদের বড় একটি সাফল্য হলেও এখনও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ, দেশের জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে এবং সংকট থেকে রক্ষা করতে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, টিসিবির ট্রাক থেকেও পণ্য কিনতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারন মানুষ। খোদ রাজধানীর অনেক জায়গাতেই এখন টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে কাগজে সিরিয়াল নম্বর লিখে তারপর দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়েই ফিরছেন অনেকে। সেখানেও লাইন এখন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ। এখন কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়াচ্ছে বললে ভুল হবে, দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বাড়ার কারণে আবারও যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে এই চাপ সাধারণ মানুষদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। তাই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তের আগে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, এমন কোনো পদক্ষেপ এখন নেয়া উচিত নয়, যার প্রভাব গিয়ে পড়তে পারে নির্বাচনে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
mortuza.hasan.shaikat@gmail.com