দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে অস্থিরতা এখন সারা বিশ্বেই। সেই করোনা সংক্রামণের শুরু থেকে যে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে তা কোনোভাবেই থামছে না। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধ মোকাবিলা করতে যেয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমাবিশ্ব যেভাবে নির্বিচারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উন্নত বিশ্বের বাজারে।
এখানে জ্বালানি তেল ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে আগে যে পরিমাণ গ্রোসারি সামগ্রী ষাট ডলার দিয়ে ক্রয় করা যেত, এখন তা ক্রয় করতে লাগে নব্বই থেকে একশ ডলার। শুধু তাই নয়, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছলচাতুরীর আশ্রয়ও নেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আগের মূল্য ঠিক রেখে দ্রব্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় পঁচিশ শতাংশ।
উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকা কানাডাতে এরকম অস্বাভবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হা-হুতাশ খুব একটা দেখা যায় না, কারণ এখানে মানুষের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগ আছে। আমাদের মতো কিছু মানুষ যারা একটু হিসাব করে চলার চেষ্টা করি এবং পারতপক্ষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে চাই না তারাই আছি বিপদের মধ্যে।
এই ক্রেডিট কার্ডের দেনা কবে, কীভাবে পরিশোধ এবং আদৌ কারো জীবদ্দশায় পরিশোধ হবে কি না তা যেমন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী জানেনা, তেমনি এখানকার কর্তাব্যক্তিরা কতটা জানে তাও একটি বড় প্রশ্ন। সে যাহোক, ক্রেডিট কার্ডের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এখানকার সমাজ এবং অর্থনীতি বেশ চলছে।
দ্রব্যমূল্য যেখানেই যাক তা নিয়ে নেই কোনো সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা। আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু তারপরও নিজের পর্যবেক্ষণ দিয়ে যতটুকু বুঝেছি তাতে মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, এসব উন্নত দেশে যদি আজ থেকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এবং সমস্ত ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ফেরত দিতে বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে এসব দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ক্রেডিট কার্ড যে এসব দেশে কত সহজলভ্য তার একটি নমুনা দেই। ওয়ালমার্ট এখানকার সর্ববৃহৎ রিটেইল স্টোর। ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও ওয়ালমার্টের নিজস্ব ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহারের সুযোগ রয়েছে এখান থেকে কেনাকাটার জন্য।
এরপরও ওয়ালমার্ট থেকে একশ ডলারের বেশি জিনিস কিনলেই সেই অর্থ ছয়মাস ধরে পরিশোধের সুযোগ দিচ্ছে শুধু এই কারণে যেকোনো গ্রাহকের যদি ক্রেডিট কার্ডে ব্যালেন্স না থাকে তারপরও যেন সে জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারে। এখানকার একশ্রেণির মানুষও আছে যারা তাৎক্ষণিক অর্থ পরিশোধ হবে না এজন্যে যা খুশি তাই ক্রয় করছে তাতে তার প্রয়োজন থাকুক আর না থাকুক এবং এর মূল্য যা-ই হোক না কেন। এসব কারণেই উন্নত বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেভাবেই হোক না কেন তা নিয়ে সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয় না।
আমাদের দেশে যেহেতু উন্নত বিশ্বের মতো নির্বিচারে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগ নেই এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিজের উপার্জনের অর্থ দিয়ে জীবনযাপনের ব্যায় নির্বাহ করতে হয়, তাই সেখানে দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে যে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। আজ থেকে যদি আমাদের দেশের প্রত্যেক নাগরিক ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য লাখ লাখ টাকার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বলে দেয়া হয় যে ক্রেডিট কার্ডের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
শুধু প্রতি মাসে একশ দুইশ করে টাকা পরিশোধ করলেই চলবে। তাহলে তখন মানুষ উন্নত বিশ্বের মতো দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোনো মাথা ঘামাবে না। যাহোক এমনটা কোনোদিন আমাদের দেশে হবে না এবং তা হওয়া কোনোভাবেই সমীচীনও নয়। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতেই হবে, যদি এর কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা না হয়।
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। কখনও রোজা, কখনও ঈদ বা কখনও জাতীয় বাজেট ঘোষণার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অশুভ প্রবণতা লক্ষ করে আসছি আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে এবং আজও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে।
বরং বলা যায় যে সেই প্রবণতা এখন বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। আর এর অনেক কারণের মধ্যে প্রধানতম কারণ আমদানিনির্ভর ব্যবসা কুক্ষিগত হয়ে আছে গুটিকয়েক বৃহৎ ব্যবসায়ীর হাতে। আরেকটা অন্যতম কারণ দেশে খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত বাড়লেও এর সুফল জনগণ পায় না শুধু আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম এবং মানসম্পন্ন বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারার কারণে।
আগে বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিজেরাই আমদানি করত। ফলে খুচরা বাজারের জন্য অনেক বিকল্প সরবরাহকারী ছিল। আমি যখন ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করি তখন অনেক ছোট ব্যবসায়ীর এলসি খুলেছি। পরবর্তী সময়ে ক্ষুদ্র আমদানিকারকের প্রতি ব্যাংকগুলোর এক ধরনের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে তারা আর আমদানি ব্যবসায় টিকে থাকতে পারেনি। এখন সময় এসেছে এসব ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের নতুন করে আমদানি ব্যবসায় নিয়োজিত করা।
এখন অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে আগ্রহী এবং যোগ্যদের মনোনীত করে টিসিবি বা অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল ব্যাক্তিদের একটি সনদ প্রদান বা নিবন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে। আর এসব নিবন্ধিত এবং সনদপ্রাপ্ত আমদানিকারকরা অনায়াসে এবং সহজশর্তে ব্যাংক থেকে এলসি খোলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং-সুবিধা পেতে পারে তার নিশ্চিয়তা বিধান করতে হবে। তাদের আমদানিকাজ এবং আমদানি পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে যাতে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা কোনোরকম বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে এবং কোনোরকম ভয়ভীতি দেখাতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এই উদ্যোগ সফল করতে পারলে যুগপৎ দুটো লাভ হবে।
একদিকে বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং সেসঙ্গে আমদানি ব্যবসা গুটিকয়েক আমদানিকারকের হাতে কুক্ষিগত না থেকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে ফলে সিন্ডিকেট বা কোনোরকম যোগসাজশে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি কঠিন হয়ে যাবে। উন্নত বিশ্বের বাজারও একসময় বৃহৎ রিটেইল কোম্পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। তখন কমিউনিটি-ভিত্তিক অসংখ্য ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে বাজারে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। অনেকেই বলবেন অনেক নতুন ক্ষুদ্র আমদানিকারক ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে পারবে না। কিছু ব্যবসায়ী হয়ত পারবে না, কিন্তু অধিকাংশই পারবে। আর এরকম সমস্যা সবধরনের ব্যবসাতেই আছে। কিছু ক্ষতি হলেও দ্রব্যমূল্য নিয় চক্রান্ত অনেকটাই ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে।
আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তাই এই কৃষির সফলতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম এবং সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উন্নত বিশ্বে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বেও এখন আর যে বছরের উৎপাদন সেই বছর ভোগ করা হয় না, বরং সুন্দর এবং মানসম্পন্ন স্টোরেজে রেখে দেয়া হয় আগামী বছর বিক্রির জন্য। ইরেডিয়েশন পদ্ধতি ব্যবহার করে আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেমের প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই।
এই পদ্ধতিতে যেকোনো পচনশীল পণ্যসামগ্রী স্টোরেজ করে রাখলে তা স্বাদ ও মানে অটুট থাকে। উৎপাদন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত দামে স্টোরেজ কোম্পানি কিনে স্টোরে যত্ন করে রেখে দিবে এবং রাখার সময়ই নির্ধারিত থাকবে আগামী বছর উৎপাদনের সময় কী মূল্যে বিক্রি করা হবে। এভাবে চলতি বছর বিক্রি করা হবে গত বছরের উৎপাদিত পণ্য যা বিশেষ স্টোরেজ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এভাবে বিক্রি করে স্টোরেজ খালি করা হবে চলতি বছরের উৎপাদিত পণ্য পুনরায় স্টোরে রাখার জন্য।
আর এসব স্টোরেজ কোম্পানির মালিক হবে স্থানীয় কৃষক যারা একদিকে স্টোরেজ কোম্পানির কাছে নির্ধারিত মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে তাদের ন্যায্যমূল্য পাবে, অন্যদিকে বছর শেষে স্টোরেজ কোম্পানির লভ্যাংশ পেয়েও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হবে। এরকম আধুনিক স্টোরেজ সিস্টেম প্রত্যেক উপজেলা এবং সম্ভব হলে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক গ্রামে গড়ে তোলা যেতে পারে। এই পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখা করার জন্য বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল।
টিসিবিকে ব্যবহার করে বা বাজার মনিটরিং জোরদার করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে কিন্তু তাতে দীর্ঘমেয়াদি তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে হলে প্রয়োজন একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা। ক্ষুদ্র আমদানিকারকের সক্রিয় করে দেশব্যাপী আমদানি অবারিত করার মাধ্যমে এবং সেসঙ্গে দেশের কৃষিপণ্য আধুনিক পদ্ধতিতে স্টোরেজ করার সুযোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল বাজার ব্যাবস্থার প্রবর্তন করলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরনটো, কানাডাপ্রবাসী