বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দ্রব্যমূল্যে একটা প্রজন্ম হতে পারে পুষ্টি ও মেধাহীন

  • দীপংকর গৌতম   
  • ১২ মার্চ, ২০২২ ১৮:৩৬

রাষ্ট্র কোনো জায়গারই লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এখন ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। জনগণের সংকটে কার কী আসে যায়? বাজার মনিটারিং হবে, গোয়েন্দারা নজর রাখছে বাজারের দিকে এসব কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে আমরা আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু পরে দেখা যায় ‘যথা পূর্বং, তথা পরং’।

দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন। দাম আর কত বাড়বে? পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরে দেখেছি ২০০ গ্রাম মাছ, ২০০ গ্রাম লাউ, করোলা কিনতে। আমার সেসব অভিজ্ঞতা একসময় বিস্মিত করত। ওখানে মানুষদের জীবন-যাপন দেখলে আমরা বাংলাদেশ থেকে যারা যেতাম অবাক হতাম। বাংলাদেশে আমরা রসিকতা করতাম ‘পুরো ডিমটাই কিন্তু খেয়ে উঠবেন দাদা।’ কিন্তু আমাদের সেই হাসি-রস শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অবস্থা এখন অনেকটাই চৈত্রের খরায় সদ্যসেচা পুকুরে যেভাবে কিলবিল করে ডানকানি মাছের পোনা। আমরা কলকাতার মতো হয়ে যাচ্ছি না তো?

ডিমের হালি ৪০ টাকা। সব দ্রব্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা বাড়ছেই। যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা কী করছে আমাদের বোধগম্য নয়। বাজারে গেলে মানুষের মুখের দিকে তাকানো যায় না। আমাদের গণপরিবহন বা শহরের রাস্তা-ঘাটে আগেও ভিখারি ছিল। এখন ভিখারির মান আগের মতো নয়। লোকলজ্জা ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে ভিক্ষায়। যখন কেউ বলে একপ্লেট ভাত খাওয়ান- তখন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো আমার বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ, ভেসে যাচ্ছে মানুষ-ভেসে যাচ্ছে মূল্যবোধ। যেসব মানুষ আগে ডালা ভরে বাজারি করত এখন তা নামকাওয়াস্তে বাজার করে। তার মানে সামনে একটা প্রজন্ম অপুষ্টিতে বেড়ে উঠছে। সেই প্রজন্ম আমার দেশে যখন নেতৃত্ব দেবে আমরা তার থেকে কী আশা করব?

করোনার সংক্রমণ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এ বাড়াটা সব দেশেই কমবেশি বেড়েছে। কিন্তু রমজানকে সামনে রেখে বাজার যে অযথাই চড়া হয়ে ওঠে এ সংকট নতুন নয়। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে এ সময় পণ্যমূল্য কমে আসা, নানা ধরনের অফার থাকে। মানুষ স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে কমমূল্যে পণ্য কেনে। আমাদের দেশে তা পুরোটাই উলটো। রমজান মাসকে কেন্দ্র করে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট কাঁচিতে শান দিতে থাকে কতভাবে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায়। মানুষ করোনার কামড়ে বড় অসহায়।

তারপরও রমজানের রোজা থেকে ইফতার করবে, সেহেরি খাবে- এগুলো তার ধর্মীয় বিধান। কিন্তু তাতে কী আসে যায় মুনাফা লোভীদের? আমরা কদিন আগে দেখেছি সয়াবিনের বাজার থেকে এক হাজার কোটি টাকা লোপাট। মুনাফালোভীরা আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে লুটে নিয়ে গেছে টাকা। এটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কী? রমজানকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতায় পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ তার মধ্যে রমজানকে সামনে রেখে লাফিয়ে বাড়ছে বাড়ছে পণ্যমূল্য ।

রাষ্ট্র কোনো জায়গারই লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এখন ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। জনগণের সংকটে কার কী আসে যায়? বাজার মনিটারিং হবে, গোয়েন্দারা নজর রাখছে বাজারের দিকে এসব কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে আমরা আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু পরে দেখা যায় ‘যথা পূর্বং, তথা পরং’। এত পদক্ষেপ নেয়ার পরে বাজার থেকে গৃহকর্তা ফিরছে পাঁশুটে মুখ নিয়ে। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এসব পণ্য আমদানির বিপরীতে এলসি কমিশন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও বাজার লাগামহীন। বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আর কত দাম বাড়বে তা জানে না কেউ।

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অন্যান্য সেবা খাদ্য-শিক্ষা, চিকিৎসাব্যয় সব বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কমাতে হচ্ছে খাদ্য, বিনোদন ও অন্যান্য চাহিদা। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ ও সেচ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবজির দাম বেড়েছে গড়ে ৪ শতাংশ। এভাবে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে তো আয় বাড়েইনি।

গত এক বছরের ব্যবধানেও বাড়েনি। উলটো অনেকের আয় কমেছে। কিন্তু তার মধ্যে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার মামলায় ফরিদপুরের সাবেক জনপ্রতিনিধি খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই। তাহলে হিসাবটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? রাজনীতিবিদ অর্থবাণিজ্য করেছে। আর সিন্ডিকেট সবখানে। এরা বাড়ছেই। জোঁকের মতো শুষে খাচ্ছে এরা। এদের সংখ্যা বেশি, এরা সংঘবদ্ধ। মানুষের টাকা খেয়ে এরা সব ফ্যাকাশে করে দেবে। আর একটি প্রজন্ম বাড়বে অপুষ্টি নিয়ে। এই বৈষম্য বাড়ছেই। বাজারে দ্রব্যমূল্যেও আগুন, সে তাপ বাবররা পান না, ধনীক গোষ্ঠী পায় না, পায় না জনপ্রতিনিধিও। যারা পায় তারা আমজনতা। তদাদের রক্ষা করবে কে?

আগামী ২৮ তারিখ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে কমিউনিস্ট পার্টি। হরতালে সাধারণ মানুষ আসবে? হয়ত না আসবে না। সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গায় এখন কেউ নেই। বরং ফেসবুকে স্ট্যাটাসকে সে মেনে নেয়। কিন্তু ফলাফলে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে খাদ্য বাজেটে কাটছাঁট করায় পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপেও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগার তথ্য উঠে এসেছে।

পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। সব মিলে এই দুই শ্রেণির মানুষের আয়ের সঙ্গে পরিবারের সব ব্যয় সামলাতে পারছে না। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছে। কম করে পণ্য কিনছে। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বের করে আনতে হবে। পণ্যের দাম কমাতে সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। কঠোর বাজার তদারকির পাশাপাশি যেসব পণ্য আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়, সেসব পণ্যের সব ধরনের ভ্যাট-শুল্ক প্রত্যাহার করা দরকার।

মজুত বাড়ানো জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে বেশি করে পণ্য ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে ছাড়তে হবে। তা না হলে আমরা অচিরেই কলকাতার মানুষের জীবনে চলে যাব। মাছে-ভাতে বাঙালি আর থাকবে না। এই লক্ষণ ভালো নয়। উন্নয়ন বাড়ছে। বৈষম্য বাড়ছে। নীতি-নৈতিকতার সংকট বাড়ছে। সবখানে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট অপার মুনাফালোভীদের নির্মূল করা না গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সরকার এ ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ না নিলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পারে না এমন কিছু আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। সরকার কি উদ্যোগ নেবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক-গবেষক, সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর