বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

চকোরিয়ার শীল পরিবারের কান্না ও দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি

  • রাজন ভট্টাচার্য   
  • ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৯:০২

চকোরিয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, যে যে ত্রুটি পাওয়া গেছে, তা সারানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কমিয়ে আনা হবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। শৃঙ্খলা ফিরবে সড়কে। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করা হবে। সারা বিশ্বে সেটাই হয়। একটি দুর্ঘটনার জন্য মন্ত্রীকেও পদত্যাগ করার নজির আছে উন্নত দেশে। এটা ছোট হওয়া নয়। দায়িত্বশীলদের দায় নেয়া মানেই উন্নত মানসিকতা ও রাষ্ট্রের উন্নত চিন্তার প্রকাশ।

পিতার শ্রাদ্ধের আগের দিন ধর্মীয় আচার শেষে বাড়ি ফেরার পথে ৮ ফেব্রুয়ারি বেপরোয়া পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু হয়। আহত আরও ২ জনের মধ্যে রক্তিম শীল টানা ১৪ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পরিবারটিতে এখন একমাত্র পুরুষ সবার ছোট প্লাবন শীল। সদ্য এইচএসসি পাস করা ছেলেটি দুর্ঘটনার ভয়াবহতায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কত সময় লাগবে কেউ জানে না।

কক্সবাজারের চকোরিয়ার মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনাটি গোটা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও সবার মধ্যে প্রতিক্রিয়া চলছে, সড়কে আর কোনো মৃত্যু দেখতে চাই না। চাই নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।

প্রায় এক মাসের ব্যবধানে একটি পরিবার থেকে সাতটি মানুষ হারিয়ে গেছে। অনিরাপদ সড়কে এরকম একটি ভয়ংকর ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে মৃণালীনি দেবীর পরিবার। ছোট শিশুগুলো অল্প বয়সে এতিম হলো। তাদের কান্না অন্তরে বিঁধেছে সবার। আকস্মিক ঝড়ে ছয় বধূর মুছে গেল সিঁথির সিঁদুর। হাত থেকে নেমে গেল সাবিত্রী। গায়ে ওঠল সাদা কাপড়।

পরিবারের ১৯টি মানুষের জীবন পুরোপুরি অনিশ্চিত। তারা কীভাবে চলবে কেউ জানে না। অথচ দায়িত্বশীল কেউ এই পরিবারটির খবর নিয়েছে বলে জানা যায়নি। অর্থাৎ দায়িত্বশীল যাদের খবর নেয়ার কথা ছিল তারা কেউ যাননি স্বামী-সন্তানহারা মৃণালিনী দেবীর কাছে। যাদের যাওয়া উচিত ছিল, তারা হয়ত বিষয়টি নিয়ে ভাবছেনই না।

প্রশ্ন হলো কারা যাবে? শোকার্ত সেই পরিবারটিতে কিংবা কেন যাবে? আশা ছিল যারা পদে আছেন, যাদের দায়িত্ব সড়ক নিরাপদ করার, তারাই যাবেন। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএর পক্ষ থেকে তাদের কেউ অন্তত মৃণালিনী শীলের বাড়িতে নিজেদের দায়িত্বের জায়গা থেকেই যাবেন। সান্ত্বনা দেবেন। ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইবেন। প্রতিশ্রুতি দেবেন সড়ক নিরাপদ করার। এখন পর্যন্ত এরকম কেউ যাননি। এ ঘটনাটি সবাইকে আরও বেশি আঘাত দেবে, আহত করবে এটাই স্বাভাবিক। এটা লজ্জারও।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান গিয়ে কথা বলতে পারতেন মৃণালীনি দেবীর সঙ্গে। তাকে অন্তত সান্ত্বনা দেয়া যেত। তিনি গিয়ে যদি বলতেন, ‘আমি চালকের লাইসেন্স দিই, ফিটনেস পরীক্ষা করি। যানবাহন ত্রুটিমুক্ত রাখার দায়িত্ব আমার। আমি পারলাম না, ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’

কারণ যে পিকআপিটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে সেটির ফিটনেস ছিল না, ছিল না চালকের লাইসেন্সসহ রুট পারমিটও। এ সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব তো বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের। আর সবরকম প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই চালক গাড়িটি দিনের পর দিন চালিয়ে আসছিলেন। এ বিষয়টি অনেক বড় দায়িত্বহীনতার পরিচয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সড়ক দেখার জন্য তো রয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। যে এলাকায় ভয়াবহ এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম ছিল। তাদেরও তো সড়ক নিরাপদ করার দায় আছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) গিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারতেন। হাইওয়ে পুলিশের প্রধানওতো তার পক্ষে যেতে পারতেন। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সেই প্রতিজ্ঞা থাকতে পারত পুলিশের পক্ষ থেকে।

আরেকটু বেশি আশা করলে যেতে পারতেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রীও। সড়ক সচিবও যেতে পারতেন। মোবাইল ফোনেও তো কথা বলার সুযোগ ছিল। কেউ গেলেন না। তবে যারা গিয়েছেন তাদের হাতে সড়ক নিরাপদ করার দায়িত্ব নয়। তারা তো এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নয়। কারো টনক নড়েনি। মানবিকতা বা দায় নেয়ার জায়গা থেকে কেউ বিষয়টি বিন্দুমাত্র অনুভব করেননি। এমন বাস্তবতাকে কি নির্দয়তা বলে না? দায় নেয়ার মানসিকতা ও সংস্কৃতি কেন গড়ে উঠছে না?

চকোরিয়ায় দুর্ঘটনার পর চালককে আটক করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বিষয়টি এমন যেন তার একারই সব দোষ। সড়ক যে নির্মাণ করল, সেই বিভাগ বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কি কোনো ত্রুটি নেই? সড়ক বিভাগ কি তা তদন্ত করে দেখেছে? কেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা চিহ্নিত করতে কোনো তদন্ত কমিটি হয়েছে? কারো যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। একেবারেই নির্বিকার সবাই। যে পিকআপটি দুর্ঘটনা ঘটাল এর মালিকের কি কোনো দায় নেই? গাড়ির মালিকও কোনোভাবে এই দায় এড়াতে পারেন না। তিনি কীভাবে এতগুলো ত্রুটি থাকার পরও গাড়িটি অদক্ষ চালকের হাতে তুলে দিলেন। তাহলে মানুষের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই?

চকোরিয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, যে যে ত্রুটি পাওয়া গেছে, তা সারানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কমিয়ে আনা হবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। শৃঙ্খলা ফিরবে সড়কে। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করা হবে। সারা বিশ্বে সেটাই হয়। একটি দুর্ঘটনার জন্য মন্ত্রীকেও পদত্যাগ করার নজির আছে উন্নত দেশে। এটা ছোট হওয়া নয়। দায়িত্বশীলদের দায় নেয়া মানেই উন্নত মানসিকতা ও রাষ্ট্রের উন্নত চিন্তার প্রকাশ।

বাংলাদেশে এমনটা দেখা যায় না। একেবারেই এ বিষয়গুলো অভ্যাসের মধ্যে নেই। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ৪৪ শিক্ষার্থী মারা গেল। ২০১২ সালে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর সড়কে প্রাণ হারালেন। এরপর নরসিংদীতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নয়জন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন। এসব ঘটনায় এলাকাভিত্তিক কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু পুরো ব্যবস্থার কি কোনো সংস্কার হয়েছে? হয়নি।

বিগত দিনেও ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও কাউকে দায় নিতে দেখা যায়নি। দায়িত্বশীলরা গিয়ে কাউকে সান্ত্বনা বা প্রতিশ্রুতি দেননি। দায়িত্বে অবহেলার কারণে শাস্তি তো দূরের কথা, কাউকে জবাবদিহির আওতায় পর্যন্ত আনা হয়নি। অঙ্গীকার মিলেনি দুর্ঘটনারোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার।

তাহলে কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে, মানুষের কান্না থামবে? অন্য দুর্ঘটনার মতোই চকরিয়ার শীল পরিবারের লোকজনও প্রতীক্ষার হয়ত প্রহর গুনছেন ঘটনার ন্যায়বিচার পাওয়ার। দায়িত্বশীলদের একটি টেলিফোন পর্যন্ত যায়নি শীল পরিবারে। অথচ সবাই বলবে এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো সরকারের উচিত। এরকম দায়-দায়িত্বহীন বাস্তবতাকে নিয়েই কি আমাদের চলতে হবে? নাকি উন্নত দেশ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের সংস্কৃতিও চালু হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর