অনেক দিন ধরেই ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা চলছিল। হুমকি-পাল্টা হুমকি, আলোচনা, সমঝোতার প্রচেষ্টাসহ- নানামুখী চেষ্টাও চলছিল। তবে আমার ধারণা ছিল উত্তেজনা যা-ই থাক, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ হয়ত মাঠে গড়াবে না। কারণ আমার ধারণা ছিল একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে অস্ত্র নিয়ে, সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করার বাস্তবতা হয়ত আর নেই। এখন বরং যুদ্ধ হয় সাইবার জগতে, অর্থনীতির মারপ্যাঁচে। কিন্তু আমার সব ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করে বৃহস্পতিবার সকালেই যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বসেন ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধের দামামা বাজতে দেরি হয়নি।
আক্রমণটা যেহেতু পুতিন শুরু করেছেন, তাই যুদ্ধের দায় অনেকে তাকেই দিতে চাইবেন। তবে বিষয়টা অত সহজ নয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ আসলে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য রক্ষার কাজ করত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র একক ক্ষমতাধর হিসেবে আবির্ভূত হয়। ওলটপালট হয়ে যায় বিশ্বরাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ। কিন্তু পুতিন রাশিয়ার সর্বেসর্বা হওয়ার পর বিশ্বরাজনীতিতে আবার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে হয়তো আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে পুতিন রাশিয়ার প্রভাব আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।
আগের প্রভাব ফিরিয়ে আনতে না পারুন, অন্তত নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে কৌশলী হওয়ার অধিকার রাশিয়া তথা পুতিনের আছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অনেকগুলো দেশ এরইমধ্যে পশ্চিমাদের প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউক্রেনও সেদিকেই ঝুঁকছিল। সাদা চোখে দেখলে স্বাধীন ইউক্রেন কোন জোটে যাবে না যাবে, সে সিদ্ধান্ত একান্তই তাদের। কিন্তু ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যেতে দেয়া আর নিজেদের উঠানে মার্কিন সেনাদের আমন্ত্রণ জানানো পুতিনের কাছে সমান। তারচেয়ে বড় কথা হলো রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের মূল পাইপলাইন ইউক্রেনের ওপর দিয়ে গেছে। তাই ইউক্রেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো মানে নিজেদের অর্থনীতিকেই বড় ঝুঁকির মুখে ফেলা।
পুতিনের মতো গোঁয়ার যে এটা হতে দেবেন না, সেটা তো জলের মতো পরিষ্কার। পুতিনের একটাই চাওয়া, ইউক্রেনকে যাতে ন্যাটোতে নেয়া না হয়। পশ্চিমারা সেটা মেনে নিলেই সমস্যা মিটে যায়। পশ্চিমারা যেভাবে পুবদিকে এগোচ্ছে, ন্যাটো যেভাবে ঘিরে ফেলছে রাশিয়াকে, সেখানে পুতিন কিছুতেই ইউক্রেনকে ছাড়বে না, এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ইউক্রেনে পশ্চিমাপন্থিরা যেমন আছে, আছে রুশপন্থিরাও। তাই বিষয়গুলো সরলভাবে মেটানো যাবে না।
সামরিক শক্তিতে বিশ্বের দ্বিতীয় রাশিয়া, আর ইউক্রেনের অবস্থান ২২তম। তাই ২-এর সঙ্গে ২২-এর যুদ্ধ একতরফাই হওয়ার কথা। কিন্তু এখানেও অঙ্কটা অত সরল নয়। ইউক্রেনের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। ইউক্রেন সংকট নিয়ে ইউক্রেনের চেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃশ্যমান উদ্বেগ বেশি। তাই পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হলে তা একতরফা তো থাকবেই না, ইউক্রেনেও সীমাবদ্ধ থাকবে না।
কেউ কেউ ইউক্রেনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। তবে অতটা ভাবতে আমার মন সায় দিচ্ছে না। দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। একক সক্ষমতা পাওয়ার পর বিশ্বের নানা প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধও দেখেছে বিশ্ব। যুদ্ধে ধ্বংস ছাড়া কিছুই অর্জিত হয় না। তাই বিশ্বের বিবেকবান নেতৃত্ব নিশ্চয়ই দ্রুত এই সমস্যার একটা কার্যকর সমাধান খুঁজে পাবেন। এখনও যুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হয়নি। অনেক পক্ষ জড়িয়ে পড়ার আগেই এর শেষ দরকার। সময় এসেছে জাতিসংঘের নিজেদের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের।
পুতিনকে চাপে রাখতে পশ্চিমারা নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তাতে রাশিয়ার তো সমস্যা হবেই। তবে সমস্যাটা শুধু রাশিয়ার হবে, এমনটা মনে করার কারণ নেই। রাশিয়া ইরান বা মিয়ানমার নয়। নিজেরা বিপদে পড়লে, অন্যদেরও সেই গর্তে টেনে আনার মতো সক্ষমতা রাশিয়ার আছে।
যুদ্ধের শুরুতেই জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। তাই সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বন্ধ হোক এই যুদ্ধ। যুদ্ধ নয়, পৃথিবীজুড়ে উড়ুক শান্তির পতাকা।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক