বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলা শুধু গরিবের ভাষা?

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৮:৫৬

আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষার জন্য যেমন ইতিবাচক মানসিকতা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বাংলাকে কীভাবে বড়লোক-গরিব সবার প্রাণের ভাষায় পরিণত করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রয়োজন। বাংলা ভাষা নিশ্চয়ই মরবে না।

মুখে আমরা যত কথাই বলি না কেন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ গরিব, নিরক্ষর, সমাজের ‘নীচু শ্রেণি’র ভাষায় পরিণত হয়েছে। অভিজাতরা ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি বা জার্মান ভাষায় পারদর্শী, অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। যারা একেবারেই ‘সেকেলে’, পিছিয়ে পড়া, তারা এখনও অফিস-আদালতে দু-চার কলম বাংলা ব্যবহার করেন। এ কালের ধনিক পরিবারের শিশুরা ‘আমার সোনার বাংলা’ শেখার আগে মুখস্থ করে নিচ্ছে ভিন্ন ভাষার রাইম। তার মাতৃভাষাহীন অমিত মেধায় অভিভাবকরাও মুগ্ধ হচ্ছেন!

যারা নিরক্ষর, গরিব, সমাজে সবচেয়ে প্রান্তিক౼ মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখার দায় যেন আজ তাদেরই। শাসক, প্রশাসক বা সমাজের ‘উঁচু’ শ্রেণির ভাষা হিসেবে বাংলা ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যাদের বয়স কম, তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে౼ এর ওপরই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। আমাদের দেশে উঠতি, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা ক্রমেই বাংলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যবর্তী বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন, এর ওপর। এই পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ নানা অর্থনৈতিক শ্রেণির অন্তর্গত। ঊর্ধ্বসীমার দিকে যারা আছেন, সেই পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হলেন এখনকার কম বয়সী মা-বাবা। তবে যে অর্থনৈতিক শ্রেণিরই অন্তর্গত হন না কেন౼ সবাই কমবেশি স্বপ্ন দেখেন, নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভালো করে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। এই স্বপ্নে ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

আগে স্কুল-কলেজগুলোয় বাংলা ভাষাতেই লেখাপড়া হতো, এখনও হয়। তবে ইংরেজি দিন দিন তার আসন পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাও অর্থকরী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যাদের টাকা আছে, তারা ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর বর্তমানে ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ মানে হচ্ছে ইংরেজিপ্রধান শিক্ষা। গরিবরা পড়ছে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর তুলনামূলক ধনীরা পড়ছে ইংরেজিপ্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এভাবে এ দুই শ্রেণির শিক্ষা, বুঝ, চিন্তা, মূল্যবোধ, স্টাইল౼ সবকিছুই আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

ক্রমেই ইংরেজিবিহীন সহজ বাংলা মিডিয়ামের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের রমরমা ব্যবসা চলছে। ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমেছে। যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, সেই অভিভাবকরা ইচ্ছা থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। কারণ ভালো বাংলা মিডিয়াম স্কুল প্রায় নেই। ফলে ইংলিশ মিডিয়াম অনিবার্য ভবিতব্য হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশে উচ্চবিত্তদের একটা অংশ দলে দলে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমছে। এভাবে দেশে স্পষ্ট দুটি শ্রেণি গড়ে উঠছে। যারা অর্থনৈতিকভাবে সবল, তারা ইংরেজি চর্চা করছে। আর গরিব চাষাভুষারা বাংলা নিয়ে পড়ে আছে। ব্যবসা ও চাকরি- সবখানে ইংরেজি জানাদের আধিপত্য, কদর। বাংলাওয়ালাদের জন্য ব্লগ আর ফেসবুকে হতাশার পদ্য রচনা ছাড়া আপাতত তেমন কোনো পুরস্কার নেই!

সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষার অবস্থা আজ বড়ই করুণ। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণের দশা অত্যন্ত শোচনীয়। কে যে কী অ্যাকসেন্টে বাংলা বলে! ওই বিচিত্রবাদিনী রাতদিন বাংলা ব্যান্ড, বাঙালির এফএম, বাঙালির চ্যানেলে নেত্য করছে। একটা বাংলা শব্দ তো সাতটা ইংরেজি।

ক্রিয়া পদের মাথামুণ্ডু নেই। মিসড কল মারে, আদর পায়, হ্যাপি থাকে। বানানের কথা বেশি না বলাই ভালো। বাংলা বই পড়ার বালাই নেই। সুতরাং গো, ওয়েন্ট, গন। বাংলা ক্রমেই চাষা-মজুরের ভাষায় পরিণত হচ্ছে। ভদ্রলোকরা বাংলাকে ক্রমেই টা টা জানাচ্ছেন। বাংলা ইলেকট্রিক চুল্লিতে গণ গনাগন হতে চলেছে। এ যেন নেভার রিটার্ন! যে ভাষা না জানলে চাকরি হয় না, ব্যবসা হয় না, বিদেশে যাওয়া যায় না- ওই ভাষা নিয়ে মেতে থাকবে কোন আহাম্মক? যাদের কিছু করার নেই, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের সাধ আছে, সাধ্য আছে- তারা কেন ‘বাংলার গান’ গেয়ে যাবে?

‘একুশের প্রথম প্রভাতফেরি-অলৌকিক ভোর।’ রক্তে রাঙানো ওই সূর্যোদয়ের গাথা কি এখন আর সত্যিই বাঙালিকে দোলা দেয়? বিশ্বায়িত দুনিয়ার নয়া ট্রেন্ড-বাঙালি গ্লোবাল হচ্ছে। একই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ভাষার বিন্যাস। মাতৃভাষা থোড়াই কেয়ার, ‘বাংলিশ’ (বাংলা ২০ শতাংশ ও ইংরেজি ৮০ শতাংশ)-এর এখন একাধিপত্য। আর অদ্ভুত কিছু বাংলা খিস্তি। এর দারুণ কদর। এই ট্রেন্ড দেখে গুলিয়ে যেতে শুরু করে নিজের অস্তিত্ব।

যদিও বাংলাকে নিয়ে মুখে মুখে গর্ব করার লোকের এখনও অভাব নেই, তবুও বাস্তবতা কী বলে? ইংরেজি না জানলে বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কারোর ভাত নেই। তা হলে বাংলা নিয়ে পড়ে থাকতে যাবে কোন দুঃখে? এখন এমন মানুষও দেখা যাচ্ছে౼ যারা বলছেন, ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বা ‘আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তে বা লিখতে জানে না।’ ঔপনিবেশিক শাসনকর্তাদের ভাষাটাকে নিজের মনে না করলে আর কোনো থৈ পাওয়া যাবে না! যুগধর্মকে অগ্রাহ্য করে খামোখা বেকারত্বের বোঝা বয়ে বেড়াতে কে চায়?

এখন এই কম্পিউটার-স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের যুগে ইংরেজির মতো শক্তিশালী ভাষা কমই আছে। কারণ এসব মাধ্যমে কাজ করতে গেলে আপনাকে ইংরেজি জানতেই হবে। ফলে এলিট ক্লাস হোক আর আটপৌরে বাঙালি কিছুটা বিভ্রান্তও বটে। কারণ বাংলা যদি ক্রমেই পিছিয়েই পড়ে, তা হলে সেটিকে আঁকড়ে থেকে লাভ কী! আর বই যদি ইংরেজিতেই পড়তে হয়, তা হলে এতে লিখলেইবা ক্ষতি কী! না, বাঙালির ইংরেজি জানা নিয়ে বা এতে পড়াশোনা করা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। থাকতেই পারে না। এখানে প্রশ্নটি বিকল্পের।

অর্থাৎ যদি কেউ চায় বাংলাকে অবলম্বন করতে, তা হলে কী সুযোগ থাকবে তার কাছে? খুবই সীমিত তা। এ জন্য তাকে নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই খুব ভালো করে বুঝতে হবে ইংরেজিকেও। দুটি ভাষা মিশিয়েই মাতৃভাষায় শিক্ষাচর্চা করতে হবে। শুধু বাংলানির্ভরতা থাকলে একটা সময় পর কানাগলিতে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক। এ জন্য নিজের ভাষাকে বিসর্জন দেয়ার মতো যে সর্বনাশের খেলায় আমরা ক্রমেই মেতে উঠেছি, ওই ভাষাকে বাঁচানোর রসদ আমরা কোথায় পাব?

আসলে আর্থসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তিতে সংখ্যাগুরু সব ভাষীর দ্বারাই অপরাপর অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোষ্ঠী (জনসংখ্যা, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক নিরিখে) শিকার হয়। আমরা ইংরাজি দ্বারা নিয়মিত পিষ্ট হই౼ এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আমরা বাংলাভাষীরা সাঁওতালি, খাসিয়া, চাকমা, মুন্ডাসহ আদিবাসীভাষীদের কি কখনও প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু দিয়ে থাকি? প্রকৃতপক্ষে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকারী বহু ভাষা এই অসম লড়াইয়ে হেরেছে অবিরত। নতুন শাসকশ্রেণির কাছে বহু সময় নতুন ভাষা গুরুত্ব পেয়েছে। এতে সব ভাষা পুষ্ট হয়নি।

কিছু স্লোগান, কিছু প্রচারসর্বস্ব কর্মসূচিতে ভাষার বিলোপকে রোখা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের মাতৃভাষার অধিকার ও বিকাশকে অন্তর থেকে স্বীকার করতে পারলে, বৈচিত্র্যকে শক্তি এবং সৌন্দর্য হিসেবে স্বীকার করতে না পারলে বিশ্বব্যাপী বহু ভাষা, বহু ভাষী রক্ষা পায়౼নচেৎ নয়। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাকে রক্ষার জন্য যেমন ইতিবাচক মানসিকতা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি বাংলাকে কীভাবে বড়লোক-গরিব সবার প্রাণের ভাষায় পরিণত করা যায়౼তা নিয়ে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাংলা ভাষা নিশ্চয়ই মরবে না। তেমন কোনো আশঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু গরিব-মেহনতি মানুষের ভাষা হয়ে বাংলা টিকে থাকলে কী লাভ? যারা বাংলা বর্জন করে ইংরেজি শিখবে কিংবা বাংলা কম জানবে౼ তারাই যদি শাসক-প্রশাসক-সংস্কৃতির ধ্বজাধারী হয়, তা হলে তো ভবিষ্যৎ ইতিহাস অন্যরকম হতে বাধ্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর