ভারতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতিটা এমনই যে, কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা নির্বাচন কমিশনারের তিনটি পদের জন্য এমন নামই সুপারিশ করে পাঠায় রাষ্ট্রপতির কাছে, যারা শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
সেখানে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্কগুলোয় অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘটনার প্রতিধ্বনি পাওয়া যাবে। যেমন: ২০০৯ সালে সংসদীয় নির্বাচনের আগে যখন সিনিয়রিটির ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলার নাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য বিবেচিত হয়, তখন তার বিরোধিতা করেছিলেন বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামী।
২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তার মেয়াদকালে এন গোপালস্বামী ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলাকে অপসারণের জন্য সুপারিশ পাঠিয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, ‘একপক্ষের’ স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য চাওলা পক্ষপাতমূলকভাবে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করছেন।
গোপালস্বামীর সুপারিশে দাবি করা হয়েছিল, চাওলা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের সময় বিরতি নিতেন এবং গোপনে কংগ্রেসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং নির্বাচন কমিশনের গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিতেন।
রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল গোপালস্বামীর এ আপত্তিতে সাড়া দেননি, তবে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল।
এই বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দেয় ২০১২ সালের মে-জুন মাসে, যখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার শাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরেশি অবসর গ্রহণ করেন। তৎকালীন বিজেপি সংসদীয় দলের চেয়ারম্যান লালকৃষ্ণ আদভানি প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে চিঠি লিখে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি জানান।
ওই চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘প্রকৃতপক্ষে, এই সিস্টেমের বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে যখন কয়েক বছর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের গুরুত্বপূর্ণ অফিসে একটি সন্দেহজনক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তাই সময় এসেছে নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার করার, যেমনটি করা হয়েছে প্রধান ভিজিল্যান্স কমিশনার ও প্রধান ইনফরমেশন কমিশনারের ক্ষেত্রে।’
বাংলাদেশের সার্চ কমিটির কাছাকাছি একটি ব্যবস্থার প্রস্তাব তুলেছিলেন আদভানি। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া ‘কারচুপি এবং পক্ষপাতিত্বের’ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে বিজেপির এ নেতা প্রস্তাব দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার এবং কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল নিয়োগের জন্য একটি কলেজিয়াম ব্যবস্থা চালু করার।
আদভানি পরামর্শ দিয়েছিলেন, কলেজিয়ামে প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী এবং লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী দলের নেতাদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার সরকার।
মজার কথা হলো, প্রগতিশীল মোর্চা সরকারের বাতিল করে দেয়া ওই সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করেনি লালকৃষ্ণ আদভানির নিজের হাতে গড়া দক্ষিণপন্থী দল বিজেপিও। গত ৮ বছর ধরে দিল্লির মসনদে বিরাজমান একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও প্রতিষ্ঠাতার সুপারিশ কার্যকর করেনি গেরুয়া দল।
ভারতে নির্বাচন কমিশন একটি স্থায়ী সাংবিধানিক সংস্থা। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার সময় কোনো সংস্থা এককভাবে স্বচ্ছ বা দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারে না, তবে নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি আর্থিক নয়, পক্ষপাতিত্বে।
এ পক্ষপাতিত্বের প্রক্রিয়ায় প্রধানসহ তিন নির্বাচন কমিশনারের কোনো একজন যদি শামিল হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে তাকে ওই পদ থেকে সরে যেতে হবে, যেমনটা হয়েছিল অশোক লাভাসার ক্ষেত্রে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত অন্যতম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন অশোক লাভাসা। কমিশনার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর লাভাসা স্পষ্টতই কিছু বিষয়ে ‘স্বাধীন’ দৃষ্টিভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহর বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ নাকচ করে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন, সে ব্যাপারে ভিন্নমত জানিয়েছিলেন লাভাসা।
প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে সেবার ছয়টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। লাভাসা এই অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে কমিশনে তার অন্য দুই সহকর্মীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। ওই ঘটনার পর লাভাসা কমিশনের বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ‘সংখ্যালঘু সিদ্ধান্তগুলো বহু সদস্যের সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পালিত সুপ্রতিষ্ঠিত প্রচলিত রীতির বিপরীতে ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।’
স্বাভাবিকভাবেই লাভাসার দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ হয়নি শাসক দল বিজেপির, কিন্তু তাকে কমিশনার পদ থেকে অপসারণ করাটাও সহজ পদ্ধতি নয়। এ জন্য অভিসংশন প্রস্তাব আনতে হবে সংসদে। সেটা কঠিন। আবার তিনি যদি কমিশনার পদে থেকে যান, সে ক্ষেত্রে সিনিয়র হওয়ার কারণে পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদে তিনি হবে প্রথম পছন্দ। এ আরেক আপদ।
আর তাই বিজেপি শুরু করেছিল ভিন্ন এক খেলা। হঠাৎ করে হরিয়ানা রাজ্য সরকারকে লাভাসার স্ত্রীর স্ট্যাম্প কর ফাঁকির অভিযোগ আরও তদন্ত করতে বলে আয়কর বিভাগ।
মিসেস লাভাসার বিরুদ্ধে গুরগাঁওয়ে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভগ্নিপতি শকুন্তলা লাভাসার কাছে হস্তান্তর করার সময় স্ট্যাম্প ডিউটি পরিশোধ না করার অভিযোগ আনা হলো। আয়কর বিভাগ ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরের জন্য মিসেস লাভাসার আয়কর রিটার্ন এবং সম্পত্তির হস্তান্তর দলিলের মধ্যে ‘অসঙ্গতি’ চিহ্নিত করল।
সরকারের দেয়া বার্তা জোরালো ও পরিষ্কার। লাভাসা দ্বিধান্বিত হন, তবে শেষ পর্যন্ত লড়াই না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৮ আগস্ট, ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দে কাছে পাঠিয়ে দেন পদত্যাগপত্র। পরে তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগদান করেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে।
পক্ষপাতিত্বের এই অভিযোগ শুধু কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই নয়, রাজ্যগুলোর নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও প্রায়শই শোনা যায়। রাজ্যে মুখ্য নির্বাচনি কমিশনার বা অফিসার নিয়োগ করেন রাজ্যপাল, রাজ্য সরকারের সুপারিশ করা নামের তালিকা থেকে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কাজ রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, লোকসভা, বিধানসভা ও বিধান পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় কমিশনকে সাহায্য করা এবং পৌরসভা, পৌর-করপোরেশন ও ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন পরিচালনা করা। রাজ্যের শাসক দল পৌরসভা বা পঞ্চায়েতগুলোতেও নিজেদের দখলদারি কায়েম রাখতে চায় এবং তখনই শোনা যায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ।
ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৬(৩) ধারা অনুযায়ী, ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকে, ‘নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে যে কোনো উপাদান’ টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো যাবে না।
১০ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণের ঠিক আগের সন্ধ্যায়, অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এএনআইকে দেয়া সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হলো দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। সেই সাক্ষাৎকারজুড়ে ছিল উত্তর প্রদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়, স্পষ্টতই যার উদ্দেশ্য ছিল বিধানসভা নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, কিন্তু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি ভারতের নির্বাচন কমিশন।
সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার বলেই মৌন থেকেছে নির্বাচন কমিশন, কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ২০১৭ সালে, নির্বাচন কমিশন একই ধারা ১২৬ ব্যবহার করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাক্ষাৎকার সম্প্রচারকারী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল। সে বছর গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোট গ্রহণের আগে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। যদিও কমিশন চার দিন পরে নোটিশ প্রত্যাহার করে। কারণ ধারা ১২৬ প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের জন্য প্রযোজ্য, মিডিয়ার জন্য নয়, কিন্তু এবার নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘টু’ শব্দটি করেনি নির্বাচন কমিশন।
অভিযোগ, পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতা খৰ্ব করার চলমান প্রক্রিয়ার অন্যতম উদাহরণ নির্বাচন কমিশন। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২৪ অনুযায়ী দেশের নির্বাচন কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা।
একজন বাঙালি, সুকুমার সেন ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার, যিনি ২১ মার্চ ১৯৫০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন ১৯৫১-৫২ এবং ১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম দুটি সাধারণ নির্বাচন সফলভাবে পরিচালনা ও তদারকি করে।
সুকুমার সেন ও প্রশাসনের উচ্চ পদে থাকা তার সহকর্মীরা সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নির্বাচনি ব্যবস্থা খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন।
১৯৮৯ সাল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে থাকতেন একজনই কমিশনার। ১৯৯০ সালে আইন সংশোধন করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সাহায্য করার জন্য আরও দুজন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সুপারিশক্রমে দেশের রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন। তাদের মেয়াদ ছয় বছর বা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত, যেটি আগে হয়। তারা একই মর্যাদা ভোগ করেন এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের সমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পান।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে শুধু সংসদ কর্তৃক অভিশংসনের (ইম্পিচমেন্ট) মাধ্যমে পদ থেকে অপসারণ করা যেতে পারে। আজ পর্যন্ত কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হননি।
১৯৫১-৫২ সালে ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর সময় যত এগিয়েছে, ভোটকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর অসদাচরণ ক্রমশ বেড়েছে। এই অসদাচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালে কেরালার বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচনে রাজ্য প্রশাসন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি ‘নির্বাচনি আচরণবিধি’ তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দল এবং রাজ্য সরকারগুলোকে নির্বাচনি আচরণবিধি পাঠিয়ে তা আন্তরিকভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকের নির্বাচনগুলো ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠীগত সহিংসতায় জর্জরিত ছিল।
১৯৯০ সালে সরকার বুঝতে পেরেছিল যে পদক্ষেপ নিতে হবে। ১৯৬২ সালে গ্রহণ করা মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট, যা ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল, তা পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর হত্যার পর নির্বাচনি সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমন ভারতের নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবে টি এন সেশানকে নিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে সেশান তার অফিসের মেয়াদ শেষ করার পর এম এস গিল ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে টি এন সেশান এবং এম এস গিল নব্বইয়ের দশকজুড়ে ভোট ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন এবং নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগ করে নির্বাচন পরিচালনায় তারা পরিবর্তন এনেছিলেন, যাতে উসকানিমূলক প্রচারাভিযান, বক্তৃতা, ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোট চুরি করা এবং নির্বাচনি সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য কৌশল প্রতিরোধ করা যায়।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আবার নির্বাচনি আচরণবিধি ভাঙার ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিটি নির্বাচনের সময় পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠছে।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট’কে ‘মোদি কোড অফ কন্ডাক্ট’ বলে কটাক্ষ করে নির্বাচন কমিশনের রোষে পড়েছিলেন। ২০১৯-এর সংসদীয় নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তৎকালীন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের বেশ কিছু অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছিল কংগ্রেস। নির্বাচন কমিশন তা নিয়ে উচ্চবাচ্য না করায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় কংগ্রেস।
দলের সাংসদ সুস্মিতা দেব আদালতে তার আবেদনে বলেন, ‘১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, বিশেষ করে সংবেদনশীল এলাকা এবং রাজ্যগুলোতে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের বিধান লঙ্ঘন এবং নির্বাচনি বিধিমালা অবজ্ঞা করছেন। এসবই পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে যে তারা ঘৃণাত্মক বক্তৃতায় লিপ্ত হয়েছেন, রাজনৈতিক প্রচারের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে বারবার ব্যবহার করেছেন, নির্বাচন কমিশনের দ্বারা এ ধরনের ভাষণে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও। আমি মোদি এবং শাহের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের সামনে একাধিকবার অভিযোগ জানালেও কোনো লাভ হয়নি। তাই আমি শীর্ষ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কমিশনকে নির্দেশ দেওয়ার আর্জি নিয়ে।’
সে সময় কংগ্রেস চার সপ্তাহে ৪০টি অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছিল। সাম্প্রতিক রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনগুলির প্রেক্ষিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে আরও শক্তিশালী করা দরকার কিনা বা রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছায় আরও নিয়ম মেনে চলা দরকার কিনা তা নিয়ে জোরদার বিতর্ক চলছে।
‘সিটিজেনস কমিশন অন ইলেকশনস’ (সিসিই) নামে একটি বেসরকারি নাগরিক সংস্থা নির্বাচন পরিচালনার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলি পরীক্ষা করে তাকে। তাদের ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু ইন্ডিয়াস ইলেকশন সিস্টেম’ শিরোনামের একটি সমীক্ষার দ্বিতীয় খণ্ডে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার বেশ কয়েকটি ত্রুটি তুলে ধরা হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতের নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি ভোটার তালিকা থেকে প্রান্তিক গোষ্ঠীর বাদ দেওয়া, নির্বাচনি বন্ডের অস্বচ্ছতা এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে বড় অর্থের শক্তিকেও চিহ্নিত করেছে তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে ‘গভীর সন্দেহ’ তৈরি হয়েছে এবং মানুষ ভাবতে শুরু করেছে যে ভারত একটি ‘নির্বাচনি স্বৈরাচার’ হয়ে উঠছে কিনা।
ক্ষমতাসীন দলের হাতে সরকারি শাসনযন্ত্রের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলেও। নেহরু নির্বাচনি ফলাফলের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলকে সঠিক উপায় অবলম্বন করার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মহারাষ্ট্রের আকোলায় ভাষণ দেওয়ার সময় নেহরু সরকারি কর্মচারীদের নিরপেক্ষ থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। নেহেরুর ভাষণটি কার্যত ‘সতর্কবার্তা’ ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘বিষয়টি তার নজরে এসেছে যে কর্মকর্তারা সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করছেন এবং নির্বাচনের বিষয়ে পক্ষ নিচ্ছেন। আমি তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি যে এটি সাধারণ হুমকি নয় যে কোনো কর্মকর্তা যদি অনৈতিক কাজ করেন বা নির্বাচনি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, তার বিরুদ্ধে পূর্ণ তদন্ত করা হবে।
‘সারা ভারতে অফিসারদের নির্বাচনি প্রচার থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং যদি কোনো কর্মকর্তা অসদাচরণে দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’
১৯৫১ সালের ২৫ আগস্ট নাগপুরে ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসংঘ আয়োজিত ‘অল ইন্ডিয়া সিভিল লিবার্টিজ কনফারেন্সে’ বক্তৃতা করার সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, নাগরিক স্বাধীনতার সুরক্ষা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি উপাদান। প্রথম সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মুখার্জি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাক-স্বাধীনতার সাথে যুক্ত করে ‘সরকার কর্তৃক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া অস্থিরতা এবং বিপজ্জনক পরিণতির’ বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন। তিনি সংবাদমাধ্যম, আমলাতন্ত্র এবং বিচার বিভাগকে ক্ষমতাসীন দল থেকে স্বাধীন হওয়ার আহ্বান জানান এবং আসন্ন (১৯৫১-৫২) সাধারণ নির্বাচনকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘এসিড টেস্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করেন।
এ সবই ছিল কাকস্য পরিবেদনা। জওহরলাল নেহেরু অথবা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দুজনেরই উত্তরসূরিরা তাদের কথিত ‘আদর্শপুরুষ’দের সতর্কবাণী ও আহ্বান বিস্মৃত হয়েছেন।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ দিতে গিয়ে অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও বিচারপতিদের সংগঠন ‘এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস'-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক জগদীশ এস ছোকার একটি রিপোর্টে লিখেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নতুন প্রকল্প উদ্বোধনের ঝটিকা অভিযান সম্পূর্ণ করতে দেয়ার জন্য নির্বাচনের দিন ঘোষণায় ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করেছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চের মধ্যে নরেন্দ্র মোদি ১৫৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। এ ছাড়া এই নির্বাচন ছিল দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম নির্বাচন। এর সময়সূচি সন্দেহ জাগিয়েছে যে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ্যে এবং নির্দ্বিধায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ছিল। নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে শাসক দলকে বাধ্য করার প্রশ্নে ধারাবাহিকতার অভাব ও ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহা ছিল নির্বাচন কমিশনের।’
এরকম অজস্র নজির ছড়িয়ে আছে। মোদ্দা কথা হলো, গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ভারতের শাসক দলগুলির কাছে ক্রমশ মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে, যার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে নির্বাচন কমিশনের গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতার ছবিটা অতি দ্রুত ধূসর হয়ে উঠছে।
লেখক: নিউজবাংলার নয়াদিল্লি প্রতিনিধি