বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

জামায়াত সম্পর্কে সাবধান থাকা দরকার 

  •    
  • ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৫:৩১

সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বাজারে ছাড়ছে। জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে।

নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হলেও তা সরকার করেনি। তাই দেশে জামায়াতে ইসলামী একই সঙ্গে আছে এবং নেই। নিবন্ধন না থাকায় জামায়াত আর নামে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তবে বেনামে বা স্বতন্ত্র পরিচয়ে যেকোনো নির্বাচনে জামায়াতের লোকেরা অংশ নিতে পারে। জামায়াত কৌশলগত কারণেই হয়তো এখন প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই। কিন্তু তারা যে সক্রিয় আছে, এর প্রমাণ নানাভাবেই পাওয়া যাচ্ছে।

সম্প্রতি সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থীরা দলের নাম নিয়ে নির্বাচন করেছে এবং বেশ কজন জামায়াত নেতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির চেয়ে জামায়াতের বেশি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে বলে পত্রিকায় তথ্য বেরিয়েছে।

এর বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতাও জামায়াত অব্যাহত রেখেছে। মাঝে মাঝেই সেরকম গোপন সভা থেকে জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের খবরও গণমাধ্যমে আসে। তাহলে জামায়াতের রাজনীতি শেষ হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারকে গত বছর একটি নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের ২৬ মার্চ জুমার নামাজের পর একদল মানুষ বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে মিছিল করার চেষ্টা করে। পুলিশ বাধা দিলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এতে কজন আহত হয়। এ ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত।

রাজনৈতিক মহলে ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন আসে যে, আসলে জামায়াত কী করছে?

অথচ জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিও করার কথা নয়। এই দলটি বাংলাদেশ চায়নি। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এরা ঘাতক, এরা দালাল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এরাও গর্তে লুকিয়েছিল। ছিল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। তারা সুযোগ পায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর। জামায়াত নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের আগমুহূর্তে পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানে থেকেও তিনি বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রাখেন।

জিয়া গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। আওয়ামী লীগকে জব্দ করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই জিয়া গোলাম আযম-জামায়াত নিয়ে কৌশলের রাজনীতি করেছিলেন। কিন্তু তার কৌশল ফাল হয়ে উঠেছে দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, একাত্তরের এই ঘাতক-দালালরা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির দুর্বলতর সুযোগ নিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। বিভিন্ন সময় কিছু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হলেও তারা ধারাবাহিকভাবেই রাজনীতিতে আছে। তাদের নিয়েও রাজনীতি আছে।

গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষত ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বাহ্যত জামায়াত সরকারি চাপের মুখে আছে। তাদের শীর্ষনেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে। কজন কারাগারে আছে। যারা বাইরে আছে তারাও অবাধে কার্যক্রম চালাতে পারছে না, দৌড়ের ওপর এবং কেউ কেউ প্রেপ্তার আতঙ্কেও আছেন। এত কিছুর পরও জামায়াত আছে।

জামায়াত আছে, কারণ তাদের পেছনে বিএনপি আছে। বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় যেহেতু জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পেরেছে সেহেতু তারা পরস্পর ভাই মনে করে। এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই বুক পেতে দেয়, পিঠ দেখায় না। রাজনৈতিক মহলের সমালোচনা, দেশের বাইরের বিভিন্ন মহলের চাপ– কোনো কিছুই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি, পারছে না।

মাঝে মাঝে আমাদের গণমাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে খবর বের হয়। কদিন নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তারপর সব ঠিক। বিএনপি-জামায়াত কেউ কাউকে ছাড়ে না, ছাড়ার কথা ভাবে না। বরং বাইরের সমালোচনা তাদের আরও কাছে আনে, কাছে টানে। ভাইয়ে ভাইয়ে শরিকানা বিরোধের মতো কিছু বিরোধ তাদের হয়তো হয় কিন্তু সেটা নিষ্পত্তি হয় নীরবে, সবার চোখের আড়ালে।

আমার ধারণা, এই বিরোধের খবর জামায়াতের পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে দেয়া হয়। মানুষকে, বিশেষ করে যারা জামায়াতবিরোধী তাদের বিভ্রান্ত করার কৌশল হিসেবেই এটা করা হয়। এ রকম খবর প্রচার হলে তাদের দিকে মনোযোগ কম থাকবে। তারা ঘর গোছানোয় অধিক তৎপর হতে পারবে। সবসময় প্রচারণায় থাকাও জামায়াতের একটি লক্ষ্য। নেগেটিভ-পজিটিভ যা-ই হোক না কেন জামায়াত আলোচনায় থাকতে চায়। এতে জামায়াতের ব্যাপারে মানুষের কৌতূহল বাড়ে। রাজনৈতিক কৌশলে জামায়াত অনেক এগিয়ে, অন্তত বিএনপির তুলনায় তো বটেই। তাই বিএনপিকে জামায়াতীকরণ করার কাজ তারা এগিয়ে নিতে সচেষ্ট আছে। আওয়ামী লীগেও তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, ঘটছে।

বিএনপি ও জামায়াতের দূরত্ব তৈরির খবর প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এটা জামায়াতের নীতিগত অবস্থান নয়, কৌশলগত। সমালোচকদের চোখে ধুলো দেয়ার কৌশল নিয়েছে জামায়াত এবং বিএনপি। দুই দলই কিছুদিন সম্পর্কের সুতা আলগা করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। তাদের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকারকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে চায় এই দুই দল। আবার এটাও ঠিক যে, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সরকারও চায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের বিচ্ছেদ।

সরকারের কাছে বিএনপি এবং জামায়াত– দুই দলই শত্রু। দুই দলের সম্মিলিত শক্তি যতটা বিপজ্জনক, আলাদা হলে ততটা নয়। সরকার দুই শত্রুকেই দুর্বল করতে চায়। তবে জামায়াতের চেয়ে বিএনপিকেই সরকার আশু বড় বিপদ বলে মনে করে বলে মনে হয়। এখন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী যতটা বিএনপি, ততটা জামায়াত নয়। তাই বিএনপিকে সরকার এখনই যতটা চাপে রাখতে চায়, জামায়াতকে হয়ত ততটা নয়। কিন্তু গত নির্বাচনের ফলাফল সরকারকে এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সুযোগ করে দিয়েছে। ভোটে জামায়াত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটি আসনেও তারা জয় পায়নি।

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিটি সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্যের বিষয়টি বিবেচনা করেই আমলে নেয়নি বা গা করছে না। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে জামায়াতের বিএনপিতে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে হঠাৎ বিএনপির শক্তি বৃদ্ধি ঘটবে, যেমন স্বাধীনতার পর পর জাসদ গঠন হলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির নেপথ্য সমর্থনে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। জামায়াতকে তাপে-চাপে রেখে সরকারও কৌশলের খেলা খেলছে। এই খেলায় সরকার এখন পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও জামায়াত খুব পিছিয়ে আছে, তেমনটা মনে করা ঠিক হবে না। জামায়াত নিজেদের মতো করে সক্রিয় আছে, তৃণমূলে মানুষের সঙ্গে নানা উছিলায় তাদের যোগাযোগ বহাল আছে।

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার একটি মামলা আদালতে আছে। মামলাটি সচল হবে, না ফ্রিজে থাকবে– সেটা নির্ভর করবে জামায়াতের ভূমিকার ওপর। এটা জামায়াতও বুঝতে পারছে। জামায়াত বুঝতে পারছে যে, তারা গরম হলে রেহাই পাবে না। সরকারও তখন গরম আচরণ করবে। তাই অকারণে শক্তিনাশের পথে না হেঁটে তারা কৌশলে শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নিষিদ্ধ হলে কোন কৌশলে আগাবে সেটাই এখন তাদের ভাবনার বিষয়। সরকারের কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা বা দূরত্ব তৈরির গল্প বাজারে ছাড়ছে। জামায়াতের চিরকালের কৌশলই এটা যে, তারা বিপদ দেখলে শামুকের মতো গুটিয়ে যায়, আবার সুযোগ বুঝে ফণা তোলে। তবে জামায়াতকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে একই কৌশল বার বার ভালো ফল দেয় না।

নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কোন কৌশলে অগ্রসর হবে তা নিয়ে দলটির ভেতর আলোচনা, বিতর্ক আছে । একপক্ষ ‘রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিয়ে সামাজিক সংগঠন হিসেবে বেশি করে সক্রিয় হওয়া’র দিকে, অন্যপক্ষ নাম পাল্টিয়ে নতুনভাবে রাজনীতির মাঠে নামাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছে। অন্ দলের ভেতরে ঢুকে কাজ করার চিন্তাও আছে। এখনও বিভিন্ন দলে জামায়াতের ‘অনুপ্রবেশকারী’ আছে। জামায়াত যদি নতুন নামে পুনর্গঠিত হওয়ার কথা ভাবে তাহলে হয়ত জামায়াতের একটি বড় অংশ বিএনপিতে বিলীন হবে।

কারণ বিএনপি হলো জামায়াতের স্বাভাবিক মিত্র। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসও কাছাকাছি। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ প্রশ্নে আগে দুই দলের অবস্থানে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও এখন তা এখন কমে এসেছে। জামায়াত যদি বিএনপিতে লীন হতে চায় তাহলে বিএনপি অখুশি হবে বলে মনে হয় না। বরং বিএনপি হয়ত তেমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছে। অবশ্য জামায়াতের কারো কারো টার্গেট আওয়ামী লীগের দিকে থাকবে না তাও বলা যায় না। জামায়াতকে দলে ঢোকানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উদারতাও দেখা গেছে।

এটা এখন স্পষ্ট যে, জামায়াত মাঠ ছাড়বে না। গোপন এবং প্রকাশ্য– দুই ধারার কাজেই তারা পারদর্শী বা দক্ষ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া তাদের আর্থিক বুনিয়াদ যতদিন দুর্বল না হবে ততদিন তারা তাদের কৌশলের খেলা অব্যাহত রাখবে। আর সরকারও জামায়াতের অর্থনৈতিক সুবিধার জায়গাগুলো তাদের কাছ থেকে কেড়ে না নিয়ে হয়ত তাদের পর্যবেক্ষণে রাখবে। তবে জামায়াতকে নিয়ে বেশি কৌশলের খেলা খেলতে গিয়ে বড় ধরনের ফাউল করার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

জামায়াত কিন্তু শেষপর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ছাড় দেবে না। বিএনপি নেতৃত্বের এক অংশ গোপন যেসব তৎপরতায় আছে, তাতে জামায়াতের অংশগ্রহণ অবশ্যই আছে। এটা মনে রাখতে হবে যে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো একই ভুল বার বার করলেও জামায়াত ভুলের পুনরাবৃত্তি কম করে। রাজনীতিতে সুস্থধারা ফিরিয়ে আনতে হলে জামায়াতের ব্যাপারে সব পক্ষেরই অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।। জামায়াতের মতো ধর্মাশ্রয়ী উগ্র রাজনৈতিক দল কখনও গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হতে পারে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ বিভাগের আরো খবর