বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শাহ আবদুল করিমের দুঃখবোধ

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৫:৪৫

শাহ আবদুল করিম বৈরাগ্যচর্চা করেননি। তিনি বাস্তববাদী গায়ক, সাধক ও মানবকল্যাণকামী। তিনি দ্রোহীও বটে। হাওরবাসীর অধিকারের প্রশ্নে তিনি মোটেও আপসকামী নন। তার রক্তে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর এক অদম্য শক্তি সহজেই ধরা পড়ে।

শাহ আবদুল করিম দুখের মহাজন। তার ছিল তীব্র দুঃখবোধ। এ বোধের মূল হেতু হাওর অঞ্চলের মানুষের কষ্ট।

২২ সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ টি এম আহমেদ কায়সারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মরমি গায়ক বলেন- ‘এই যুগেও দেখেন যোগাযোগ, শিক্ষাদীক্ষায় কতো অবহেলিত ও উপেক্ষিত।… ছোটবেলায় দুঃখ যে কী জিনিস, দারিদ্র্য যে কী জিনিস মর্মে মর্মে টের পেয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেছিলেন- ‘আমি বেহেশত চাই না, দোজখ চাই না জীবিত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই।”

শাহ আবদুল করিমের ওপর দুখের খড়গ নামে শৈশবে। সুমনকুমার দাশ তার শাহ আবদুল করিম জীবন ও গান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, দাদা নসিবউল্লাহ মারা যাওয়ার পর শাহ আবদুল করিমের পরিবারে অভাব দেখা দেয়, সংসারে অশান্তি বাড়তে থাকে। করিমের জন্মের সময় তাদের পরিবারের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছলই ছিল, সামান্য কিছু জমিও ছিল। কিন্তু করিমের পরে তার পাঁচ বোনের জন্ম নেয়ায় সংসারে সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়, অভাব প্রকট হয়ে ওঠে।

পরিবারের অভাব দূর করতে শাহ আবদুল করিম মাত্র দুই টাকা বেতনে গ্রামের মোড়লবাড়িতে চাকরি নেন। বর্ষা মৌসুমে হাওর যখন পানিতে ডুবে থাকে তখন গুরু চড়ানোর কাজ থাকত না। এ সময় শাহ আবদুল করিম মুদি দোকানে চাকরি নেন। শুষ্ক মৌসুমে গরু চড়ানো আর বর্ষা মৌসুমে মুদির দোকানে কাজ দিয়ে চলছিল শাহ আবদুল করিমের জীবন। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে শাহ তিনি গরু চড়ানো চাকরি ছেড়ে দেন। গরু চড়ানোকে তিনি চাকরি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, যা তাঁর নিজের ভাষ্যে উঠে এসেছে। শাহ আবদুল করিম গেয়েছেন-

গরু নিয়ে প্রতিদিন হাওরে যাই

ঈদের শুভদিনেও আমার ছুটি নাই।

দুঃখবোধের সঙ্গে তার সখ্য ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং তা নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। এ নিয়তিই তার প্রকাশভঙ্গি নির্মাণ করে দেয়। আর এ সৃষ্টিই হয়ে ওঠে তার পরিচয়ের স্মারক।

শাহ আবদুল করিমের মা চাইতেন করিম একটু লেখাপড়া করুক। কিন্তু তার বাবা ছিলেন খুব সরল-সোজা, তবে কুৎসিত বাস্তবতা তার জানা ছিল। বাউলসম্রাট জানাচ্ছেন, তার বাবা বলতেন আগে হলো খায়্যা বাঁচা, তারপর লেখাপড়া।

মরমি সাধক আরও জানাচ্ছেন- ১৯৩০ সালের দিকে তার গ্রামে স্থাপিত একটি নৈশ বিদ্যালয়ে তিনি আটদিন লেখাপড়া করেন। একপর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পড়াশোনা শেষে ছাত্রদের যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হবে। এ গুজবে স্কুলে ছাত্রসংকট দেখা দেয় এবং ছাত্রের অভাবে একদিন স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।

সুমনকুমার দাশ জানাচ্ছেন- এরপরও শাহ আবদুল করিম হাল ছেড়ে দেননি। সময়-সুযোগ পেলে আগায় লোহা লাগানো কঞ্চি দিয়ে মাটিতে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জণবর্ণ লিখে তা মুখস্থ করতেন। যে অক্ষরগুলো তিনি বুঝতেন না, অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন যাকে পেতেন তার কাছ থেকে জেনে নিতেন। এভাবেই তার অক্ষর শিক্ষা হয়। মাটির জমিন হয়ে ওঠে তার স্লেট-খাতা।

বাংলা পঞ্চাশটি বর্ণ তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলেও তিনি বর্ণ দিয়ে জীবনবোধ নির্মাণ করেননি। তিনি জীবনবোধ নির্মাণ করেছেন অনুভব ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সংযোগ শাহ আবদুল করিমের শিখনের মূল হাতিয়ার।

যা ক্ষয়হীন তাই অক্ষর। ক্ষয়হীন সত্তা শরীরে প্রবেশ করলে অনেকাংশে পর্যবেক্ষণের সজিবতা নষ্ট হয়। জীবন ও জগৎ পড়ে বর্ণের শাসনে।

লোকসংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়ার শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে লেখা পরম-সত্য বা আধ্যাত্মিকতা শুধু কালির লেখায় আলিম হয় না প্রবন্ধে বাউলসম্রাটের একটি গান উদ্ধৃত করেছেন-

শুধু কালির লেখায় আলিম হয় না মন রে কানা

অজানাকে যে না জানে

আল্লাহ-নবী-আদমছবি একসুতো বাধা তিনজনে।

সাইমন জাকারিয়া আরও উল্লেখ করেন, এ গানে পরম-সত্য প্রকাশে কালির লেখাকে অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মন-কানার অন্ধকার তখনই দূর হয় যখন অজানাকে জানা যায়, আর তার জন্য শুধু কালির লেখার জ্ঞান আহরণ বা বিদ্যাশিক্ষা একমাত্র পন্থা-পদ্ধতি নয়। জানাতে হয় আপন সত্তার অজানা এক খবর।

মরমি বা আধ্যাত্মিক বিষয়টা কাল্পনিক বা কোনো স্বপ্নপ্রবণ ঘটনা নয়, আসলে তা সাধকের জীবনের পরম সত্য, একে বাস্তব সত্য বলা যায়। জীবনের এ গূঢ় সত্যকে জানার জন্য সাধকেরা গুরুর অনুগামী হন বা শিষ্যত্ববরণ করেন। অবশেষে বেঙ্গল কমিউনেশনে গুরু-চ্যালা রিলেশন হয়ে ওঠে পরম সত্য জানার এক বিশেষ ধরন।

বাঙালি সংস্কৃতিতে ব্র্যাত্য সাধক ও গায়কেরা যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তখন তারা ভাব প্রকাশে ভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন কথার। তারা যে ভৌগোলিক পটভূমিতে জন্ম নিয়েছেন সেটাই হয়েছে তাদের টেক্সট বা আধেয়। যেমন- হাওরের বিস্তৃত জলরাশি শাহ আবদুল করিমের টেক্সট। তিনি বিস্তৃত জলরাশি পড়েছেন আর অনুভবের মালা গেঁথেছেন। বলা হয় হাওর অঞ্চলে জন্ম নিলে দুটো বিষয় শিখতে হয়; এক. সাঁতার; দুই. গান।

আর এ গানই হলো জ্ঞান। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাদের বঙ্গীয় শব্দার্থকোষে গান সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষদের বিচারে গান কেবল শব্দ-সুর, তাল-লয়-ভাবের ধারক ছিল না, ছিল অভিজ্ঞতা-জ্ঞান, তথ্য-ভক্তি-বিশ্বাস, পণ্য-চাহিদা-জোগান, মূল্য-পুঁজিরও ধারক।

লোকজচিন্তক ও সাধকদের অভিব্যক্তি এককথায় অসামান্য। এরাই ওরাল ফর্ম অব বেঙ্গল কমিউনিশনের মূল সূত্রধর। যুগ যুগ ধরে এ ধারা বহমান। এর মধ্য দিয়ে লোকজ গুণীজন জ্ঞান ও বৃদ্ধিবৃক্তিক সাধন চালিয়ে গেছেন। Communication and Culture in Ancient India and China বইয়ে রবার্ট টি অলিভার বলছেন, `Oral tradition is considered in relation to philosophy and social custom' (দর্শন ও সামাজিকপ্রথার সঙ্গে এ ওরাল ট্রেডিশন গভীরভাবে প্রোথিত)।

শাহ আবদুল করিমের সুর আর কথার মুগ্ধবিন্যাস বড় শ্রবণ নান্দনিক। এ মরমি গায়কের ছিল- নিজস্ব জীবনবোধ, গ্রহণউন্মুখ মন ও খোলা হৃদয়। তিনি বর্ণ দিয়ে দেখেননি দেখেছেন হৃদয়ের খোলা জানালা দিয়ে।

শাহ আবদুল করিম বৈরাগ্যচর্চা করেননি। তিনি বাস্তববাদী গায়ক, সাধক ও মানবকল্যাণকামী। তিনি দ্রোহীও বটে। হাওরবাসীর অধিকারের প্রশ্নে তিনি মোটেও আপসকামী নন। তার রক্তে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর এক অদম্য শক্তি সহজেই ধরা পড়ে।

সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন- গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন- জীবীত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। এই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে, আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একদা তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ত্ব নয়, নিঃস্ব-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, আর সোনার বাংলা, আর সোনার মানুষ বললে হবে না। লোভী, শোষক আর পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে। তিনি গেয়েছেন-

তত্ত্ব গাইলেন, গেয়ে গেলেন; যারা মরমি কবি

আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি

বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তিবিধান

মন মজালে ওরে বাউল গান।

আগেই বলা হয়েছে শাহ আবদুল করিমের গানের মূলরসদ তার দুঃখবোধ। তার দুঃখের ব্যঞ্জন বড় সুস্বাদু। তিনি শ্রোতাদের মনোজগতে দুঃখের বাণ ছুড়েছেন। সেই বাণে শ্রোতারা হয়েছেন আবেশী। সবার দুঃখ আপন করে গানের ডালি সাজিয়েছেন।

শাহ আবদুল করিমের অভিব্যক্তি ও গায়কি প্রমাণ করে তিনি একক জীবনযাপন করেননি অনেকের জীবন একসঙ্গে যাপন করে গেছেন। দুঃখ-ক্লিষ্ট মানুষের সত্যিকার প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন।

শাহ আবদুল করিমের ছিল পাবলিক ও প্রাইভেট দুঃখ। হাওর অঞ্চলের হাজারও মানুষের দুঃখকষ্ট তাকে ব্যথিত করেছে; একইসঙ্গে স্ত্রী আফতাবুন নেসা সরলার মৃত্যু তার ৪০ বছরের দাম্পত্য জীবনে ছেদ ফেলেছে। তিনি স্ত্রী বিয়োগে মুষড়ে পড়েছেন।

শাহ আবদুল করিমের দুঃখবোধ কোনো পোশাকি ব্যাপার নয়। তিনি যা অনুভব করেছেন তা মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন। প্রকাশে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ মহান গায়কের চিন্তা, জীবনযাপন ও প্রকাশের মধ্যে কোনো অসংগতি নেই। তিনি সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব। এজন্য তিনি অতিদ্রুত হাওরবাসীর কাছে প্রিয় ‘করিম ভাই’ হয়ে উঠেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন আস্থার প্রতীক।

তিনি যা অনুভব করেছেন তা দিয়ে গান বেঁধেছেন এবং সুর চড়িয়েছেন। হাওরের বিস্তৃত জলরাশি ও তার অনুষঙ্গগুলো তার গানের ক্ষেত সমৃদ্ধ করেছে।

মিহিরকান্তি চৌধুরী ‘শাহ আবদুল করিম জীবন ও কর্ম গ্রন্থে’ শাহ আবদুল করিমের গানের কতক ভাবগত দিক বের করেছেন- যেখানে ইতিহাসের উপাদান (ইসলামের ইতিহাস, রাজনৈতিক ইতিহাস), ভালোবাসা, প্রকৃতি ও পরিবেশ, স্মৃতিকাতরতা, ধর্মভাবনা, মন মানুষের সন্ধানে, গণসংগীত প্রসঙ্গ, দেহতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ প্রসঙ্গ, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব। সুমনকুমার দাশের বর্গীকরণটা একটু ভিন্নধর্মী- পীর-মুর্শিদ স্মরণ, ভক্তিগীতি, মনোশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, বিচ্ছেদ, গণসংগীত, সারিগান ও আঞ্চলিক পর্যায়ভুক্ত।

বৃহত্তর হাওর অঞ্চলের দুখের উনুনে হীমশীতল পানি ঢালার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন শাহ আবদুল করিম। তার গান, সুর ও গায়কি হয়ে উঠেছিল ‘শান্তিবিধান’ প্রতিষ্ঠার মূল শক্তি। তিনি কেবল গায়ক নন মানুষের অধিকার আদায়ে অগ্রজ সুরবীণা।

শাহ আবদুল করিম যুক্তিনির্ভর জীবনযাপন করেছেন। প্রথাগত ধর্মে তার আস্থা ছিল না। তিনি এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট বলেন-‘আমি কখনই আসমানি খোদাকে মান্য করি না।’ মানুষের ভেতর যে খোদা বিরাজ করে তার ওপর তার ভক্তি। তিনি আরও বলেন-‘সবার উপর মানুষ সত্য এ হলো আমার ধর্ম’।

শাহ আবদুল করিমের আহবান- ‘‘দেখে যান এখানে, এ বিশাল ভাটি অঞ্চলজুড়ে মানুষগুলো কী অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে বাস করে। লোকে কয় আমি নিরন্ন দুঃখী মানুষের কবি, আমি আসলে তাক ধরে দুস্থদের জন্য কিছু লিখিনি। আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই, ভাটি অঞ্চলের একজন বঞ্চিত, নিঃস্ব, দুঃখী মানুষ আমি, আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়’’ (সূত্র: সুমনকুমার দাশ (সম্পাদিত); শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন, পৃ. ৯৫; উৎস প্রকাশন, ঢাকা)।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

এ বিভাগের আরো খবর