২০২২ সালে মুক্তিযুদ্ধ শ্রেণিতে এমন একজন একুশে পদক পেয়েছেন, যিনি কেবল মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনার ছবি তুলেই রাখেননি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সবাক সচল ছবি সংরক্ষণ করেছেন।
তিনি আমজাদ আলী খন্দকার। তার ক্যামেরায় ধারণ করা স্থির ও সচল ছবি মুক্তিযুদ্ধের জ্বলজ্বলে ইতিহাসের সাক্ষ্য, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা।
দিন নিরন্তর বয়ে যায়, স্মৃতিপট ছবির মতো ধরে রাখে ঘটনাগুলো। তেমনি মুক্তিযুদ্ধে সেই আগুনঝরা দিনগুলোর স্মৃতিপটের একটা অংশ যেন আমজাদ আলী খন্দকারের ক্যামেরা। তবে তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা বন্ধুবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সংরক্ষণ ও পরিচর্যায়।
আমজাদ আলী খন্দকার অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি চাকরিজীবী। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রধান ক্যামেরাম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে অবসরে যান। বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন ১৯৭৯ সালে। এর আগে তিনি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) সহকারী ক্যামেরাম্যান ছিলেন।
আমজাদ আলী খন্দকার কর্মজীবন শুরু করেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে। সেটা ১৯৬৫ সালের কথা। সেখান থেকে ১৯৬৮ সালে যোগ দেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ফিল্ম ডিভিশনের সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে।
৭ মার্চ, ১৯৭১। সারা পূর্ববাংলা আন্দোলনে উত্তাল। নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের বঞ্চনা ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা তো হস্তান্তর হচ্ছে না! টালবাহানা শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। লাখ লাখ জনতা সমবেত হয়েছে রমনার রেসকোর্স ময়দানে।
তখন ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন মোহেব্বুর রহমান খয়ের (প্রয়াত প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের)। তিনি সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সেলুলয়েড ফিতায় বন্দি করতে। তৎকালীন সরকার এ বিষয়ে কিছুই জানত না। তার নির্দেশে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হন জি জেড এম এ মোবিন (ক্যামেরাম্যান), এম এ রউফ (ক্যামেরাম্যান), মো. আমজাদ আলী খন্দকার (সহকারী ক্যামেরাম্যান), এস এম তৌহিদ বাবু (সহকারী ক্যামেরাম্যান), সৈয়দ মইনুল আহসান (সহকারী ক্যামেরাম্যান), হাবীব চোকদার (লাইটবয়) ও জোনায়েদ আলী (লাইটবয়)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণ শেষ করলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, এই পরিস্থিতিতে কী কী করতে হবে। ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ভাষণ ধারণ করে ফিরলেন তারা অফিসে। তখন ফিল্ম ডিভিশনের অফিস ছিল সচিবালয়ের ভেতরে টিনশেডে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যা অভিযান ঢাকা শহরকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। মোহেব্বুর রহমান খয়ের চিন্তায় পড়ে যান। তিনি আশঙ্কা করেন যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যদি এই ভাষণের খবর পেয়ে যায়, তা হলে তা নষ্ট করে ফেলবে। যে করে হোক, সচিবালয় থেকে ভাষণের সব কিছু সরিয়ে ফেলতে হবে। তিনি আস্থাভাজন সহকর্মী আমজাদ আলী খন্দকারকে দেখা করতে খবর দেন। পুরো বিষয়টি আমজাদ আলীকে বুঝিয়ে বলেন। তিনি ভাষণের সবকিছু নিয়ে সোয়ারীঘাট হয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলার জয়পাড়া নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
তখন পুরো ঢাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সচিবালয়ও তখন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাঙালি অফিসার-কর্মচারীদের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে সচিবালয় থেকে ভাষণের ক্যান ও অন্যান্য জিনিস বের করা কঠিন কাজ। সামরিক বাহিনীর লোকজন বুঝতে পারলে মৃত্যু অনিবার্য। এরপর সচিবালয় থেকে সোয়ারীঘাট। পথে পথে সামরিক বাহিনীর টহল। এত বিপৎসংকুল বাধা পেরোতে হবে জেনেও আমজাদ আলী খন্দকার রাজি হন। তবে শর্ত দেন যে, কাজটির আগে তিনি বাবার কাছ থেকে দোয়া নিতে চান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনের আগে বাবার কাছ থেকে বিদায় নেন আমজাদ।
৯ এপ্রিল, ১৯৭১। আমজাদ আলী খন্দকার একটি স্টিলের ট্রাঙ্ক কিনে নিয়ে সচিবালয়ে তার দপ্তরে প্রবেশ করেন। প্রতি মুহূর্তে তাকে ভাবতে হচ্ছিল কেউ দেখে ফেলে কি না। একে একে ভাষণের মূল কপি, অডিও-ভিডিও ফুটেজসহ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ট্রাঙ্কে ভরে ফেলেন তিনি। কৌশল করে প্রহরায় নিয়োজিত একজনের সাহায্য নিয়ে বের হন। প্রহরায় নিয়োজিত ব্যক্তি জানতেন না কী নিয়ে যাচ্ছেন আমজাদ। সেখান থেকে বেবিট্যাক্সিযোগে সোজা সোয়ারীঘাট। নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে জিঞ্জিরা যান। সেখান থেকে পথের অনেক ঝক্কি-ঝামেলা মোকাবিলা করে পৌঁছে যান মুন্সিগঞ্জের জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। প্রায় একই সময়ে ভিন্নভাবে মোহেব্বুর রহমান খয়েরও সেখানে উপস্থিত হন। তারা ভাষণের ট্রাঙ্কটি অত্যন্ত গোপনে লুকিয়ে রাখেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার এভাবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ রক্ষা করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপিরবারে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীরা ৭ মার্চের ভাষণ বিনষ্ট করারও চেষ্টা চালায়। স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্র চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে তল্লাশি চালায়।
এ সময়ে আমজাদ আলী খন্দকার ডিএফপিতে কর্মরত। একদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করা ভাষণ আজ তাদের প্রেতাত্মাদের হাতে বিনষ্ট হবে! আমজাদ আলী খন্দকার কয়েকজন বিশ্বস্ত সহকর্মীকে নিয়ে ভাষণের অডিও-ভিডিও ফুটেজগুলো অন্য ছবির ক্যানে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখেন এবং ৭ মার্চের ভাষণ লেখা ক্যানে অন্য একটি ছরির নেগেটিভ ভরে রাখেন। ষড়যন্ত্রকারীরা ৭ মার্চের ভাষণ মনে করে সেই ছবির রিল ধ্বংস করে স্বস্তি পায়। এভাবে রক্ষা পায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। তারপর থেকে এ ভাষণটি সবার জানার অন্তরালে চলে যায়।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। এ সময়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওচিত্রের অনুসন্ধান চালানো হয়। ততদিনে আমজাদ আলী খন্দকার ডিএফপি ছেড়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) যোগ দিয়েছেন। অনুসন্ধানের খবর পেয়ে আমজাদ আলী খন্দকারসহ তার বিশ্বস্ত সহকর্মীরা ভাষণটির কথা সরকারকে জানান। বের করা হয় লুকিয়ে রাখা ঐতিহাসিক অমূল্য দলিল। অযত্ন আর অবহেলায় ততদিনে ভাষণের প্রিন্ট অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বিদেশে পাঠানো হয় এর উন্নয়নের জন্য। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর ভাষণটির ভিডিওচিত্রটি পরিস্ফুটন ও উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রদর্শন উপযোগী করে। সেই ভাষণই আজ আমরা দেখছি বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এই ঐতিহাসিক ভাষণ ধারণ, পরিস্ফুটন এবং পরবর্তীকালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তা সংরক্ষণ করায় আমজাদ আলী খন্দকারের ভূমিকা অসাধারণ। তার এই ভূমিকার ফলেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের অডিও-ভিডিও চলচ্চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এটিই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের একমাত্র অডিও-ভিডিওচিত্র। এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশের সংবাদমাধ্যম বা ব্যক্তির কাছে এই অমূল্য দলিলের কোনো ভিডিওচিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য। স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের ইউনেসকোতে পাঠানো হয় ডিএফপির পরিস্ফুটনকৃত কপি। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো আনুষ্ঠানিকভাবে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। ইউনেসকো চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরকে সম্মাননা সনদ প্রদান করে। কিন্তু ভাষণটি রক্ষার জন্য যিনি জীবন বাজি রেখেছিলেন, সেই আমজাদ আলী খন্দকার থেকে যান অন্তরালেই।
৭ মার্চ ২০২০ সাল। কয়েক দিন আগেই আমি এই অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পাই। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ ও সংরক্ষণে সাহসী ভূমিকা পালনকারী আট জনকে ৭ মার্চ ডিএফপি থেকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ সময়ে আমজাদ আলী খন্দকার অন্যান্য সহকর্মীদের উপস্থিতিতে ভাষণটির চিত্রধারণ ও রক্ষায় তার কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। এই বক্তব্য বর্তমান সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে।
আমজাদ আলী খন্দকারের সঙ্গে আমার পরিচয় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। তখন তিনি বিটিভির ক্যামেরাম্যান। সম্মাননা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হয়। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। একদিন আগ্রহ ব্যক্ত করেন একুশে পদকে নাম পাাঠানোর জন্য। বিষয়টি মন্ত্রীকে অবহিত করলে তিনিও উৎসাহ দেখান। সচিব মো. মকবুল হোসেনও উৎসাহী হন। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একুশে পদকের জন্য আমজাদ আলী খন্দকারের নাম পাঠানো হয়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো নামের সমর্থনে প্রস্তাব সরকারের কাছে পৌঁছে দেন।
আমজাদ আলী খন্দকারকে মুক্তিযুদ্ধ শ্রেণিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে পদকের জন্য অনুমোদন দেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবের প্রতি।
আমজাদ আলী খন্দকার অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। তার খুশির সঙ্গে সমভাবে ডিএফপি আনন্দিত। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করায় ব্যবহার করা ক্যামেরা ও শব্দ ধরণের নাগ্রা মেশিন এখন ডিএফপির জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে৷
লেখক: মহাপরিচালক, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর