১০ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ৪০৩টি আসনের জন্য নির্বাচনের প্রথম দফায় ৫৮টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়ে গেল। সামগ্রিকভাবে ভারতের রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশের সব থেকে বড় এবং জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ৮০টি আসন এই রাজ্যে। স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির মসনদ কার দখলে থাকবে, তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে হিন্দি বলয়ের এ রাজ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে। অর্থাৎ আগামী দুই বছরে যে রাজ্যগুলোয় বিধানসভা নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনগুলোকে আগামী সাধারণ নির্বাচনের সেমিফাইনাল হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দেশের এবং উত্তরপ্রদেশের মসনদে বর্তমানে বিজেপির দখল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আদর করে বলেন, ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’। তিনি গত বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনি প্রচারেও ডাবল ইঞ্জিন সরকারের তত্ত্ব খাড়া করে ভোটারদের বোঝাতে চেয়েছিলেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই সরকার থাকলে উন্নয়নে গতি সঞ্চার হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা অবশ্য মোদির এই তত্ত্বকে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করে খারিজ করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনি প্রচারেও নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহরা ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ তত্ত্বের আধারে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাইছেন।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনি আচরণবিধি চালু হওয়ার আগে তিন মাস ধরে উত্তরপ্রদেশে নরেন্দ্র মোদি ও আদিত্যনাথ মহাসড়ক, নতুন বিমানবন্দর, স্টেডিয়ামের শিলান্যাস, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকারের’ যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। এর জবাবে বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব বলেছেন, ‘যদি বহুমাত্রিক সূচক সম্পর্কিত ১২টি সূচকের ভিত্তিতে বলা হয়, তবে উত্তরপ্রদেশের মানবসম্পদ ভারতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার।’ উত্তরপ্রদেশের একটি বৃহৎ জনসংখ্যা সেই মৌলিক সুযোগ-সুবিধা এবং চাহিদা থেকে দূরে, যা অর্জন করতে পারলে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙার ক্ষমতা পাওয়া যায়। এর অর্থ, উত্তরপ্রদেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ এতটাই দরিদ্র যে তাদের পাশে সরকার না থাকলে তারা তাদের দারিদ্র্য ভাঙতে পারে না।
এমন দারিদ্র্যের মধ্যে লেখাপড়া শেখানো অনেকের পক্ষেই কঠিন। শিক্ষার অবস্থা খারাপ। নীতি আয়োগের ‘দ্য সাকসেস অফ আওয়ার স্কুল কোয়ালিটি ইনডেক্স’-এর রিপোর্ট অনুসারে, উত্তরপ্রদেশ ভারতের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্য। এটি সর্বনিম্ন স্তরে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুসারে, সামগ্রিক পারফরম্যান্স স্কোর ছিল কেরলের জন্য ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং উত্তরপ্রদেশের জন্য ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ শিক্ষার অবস্থার উন্নতির জন্য উত্তরপ্রদেশকে এখনও মাটি ও আকাশের সমান দূরত্ব পেরোতে হবে।
দরিদ্র শিশুদের মিড-ডে মিলের বাজেট থেকে বড় হোর্ডিং লাগানোর ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। ক্ষুধায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যায় উত্তরপ্রদেশ এক নম্বরে। করোনার সময় ওষুধের কালোবাজারিতে এক নম্বরে। বেসামরিক নাগরিকদের বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে এক নম্বরে। গঙ্গা নদীর তীরে পুঁতে রাখা মরদেহ থেকে কাফন সরানোর ক্ষেত্রে এক নম্বরে। এই কঠিন বাস্তবের কোনো ব্যাখ্যা নেই বিজেপির কাছে। আর তাই প্রায় এক দশক আগের মুজাফফরনগর দাঙ্গার সত্য-মিথ্যা কাহিনি এর সব শীর্ষ নেতা তুলে ধরেছেন এবং বিরোধীদের ভোট দিলে ‘মুজাফ্ফরনগর আবার জ্বলবে’ এমন কথা বলে অমিত শাহ জনগণকে ভয় দেখাচ্ছেন। বিজেপির তারকা প্রচারকরা এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশান্তর, হয়রানির বিষয়টি জোরেশোরে তুলেছেন। বলা হচ্ছে, ২০১৭ সালে বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলার বিস্তর উন্নতি হয়েছে।
বাস্তবটা কী? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ ২০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ৫৬ হাজার নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যেখানে ২০১৮ সালে ৫৯ হাজার ৪৪৫টি কেস নথিভুক্ত হয়। বছরের পর বছর ধরে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশে অপহরণের ২১ হাজার ৭১১টি, দাঙ্গার ৮ হাজার ৯০৮টি এবং ডাকাতির ৩ হাজার ২১৮টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সহিংস অপরাধের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের মতো শিশুদের বিরুদ্ধেও অপরাধ গত কয়েক বছরে বেড়েছে। ২০১৮ সালে শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের ১৯ হাজার ৯৩৬টি, ২০১৭ সালে ১৯ হাজার ১৪৫টি এবং ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৯টি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
এসব তথ্য তুলে ধরেই ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্বকে তুলোধোনা করছে সমাজবাদী পার্টি জোট, কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। এবার উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কংগ্রেস একাই লড়ছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর নেতৃত্বে। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেই কংগ্রেসের আসনসংখ্যা তলানিতে ঠেকেছিল। সেবার জয়ী হওয়া দলের সাত বিধায়কের মধ্যে পাঁচজন গত পাঁচ বছরে দফায় দফায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে লড়ছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে।
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর নেতৃত্বাধীন বহুজন সমাজ পার্টি এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তাদুল মুসলিমিন বা মিম ভোটযুদ্ধে অংশ নিলেও কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোট কেটে তারা বিজেপি প্রার্থীকে সুবিধা পাইয়ে দিতে পারে।
মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে সমাজবাদী পার্টি নেতৃত্বাধীন জোটের। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে জোটের প্রধান সঙ্গী রাষ্ট্রীয় লোকদল। জাঠ কৃষক ও মুসলমান অধ্যুষিত এই অঞ্চলের দিকে এবার বিশেষ নজর রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের। কারণ গত জানুয়ারিতে শেষ হওয়া ১৩ মাসের কৃষক আন্দোলন। ধর্মীয় বিভাজন ভুলে ওই আন্দোলনের শরিক ছিলেন পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা, বিশেষ করে আখচাষিরা।
মনে রাখা প্রয়োজন, ২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০১৭-এর বিধানসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলে ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিয়ে বাজিমাত করেছিল বিজেপি। কৃষক আন্দোলনের প্রভাবে গড়ে ওঠা গ্রামীণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক জোট কি বিজেপিকে হারাতে ভোট দেবে বিরোধীদের?
আজকের দিনের কোটি টাকার প্রশ্ন এটিই। কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাকেশ টিকাইত নির্বাচনে বিজেপিকে শাস্তি দেয়ার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ হিন্দু-মুসলমানের ম্যাচের স্টেডিয়াম নয়।’ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা রাজ্যজুড়ে ‘বিজেপিকে শাস্তি দাও’ প্রচার অব্যাহত রেখেছে। কৃষক নেতারা যখন সাংবাদিক সম্মেলন করে কৃষকদের শহীদ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তখন মোদি-যোগী-শাহের ক্ষমতার সবচেয়ে বর্বর, নিষ্ঠুর প্রতীক হিসেবে সেই চিত্র ফুটে উঠছে।
মোদি-শাহ-যোগী ত্রয়ী প্রতিনিয়ত মেরুকরণের এজেন্ডাকে তীক্ষ্ণ করতে তৎপর। যোগী উত্তরপ্রদেশের জনগণকে সতর্ক করে বলেছেন, তারা ভোট না দিলে উত্তরপ্রদেশ কাশ্মীর, কেরালা এবং বাংলায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।
বিজেপির নির্বাচনি ইশতেহারে বলা হয়েছে ,‘লাভ জিহাদের শাস্তি ন্যূনতম ১০ বছর এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা বৃদ্ধি করা হবে।’ উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিধানে বা ভারতীয় ফৌজদারি আইনে ‘লাভ জিহাদের’ কোনো সংজ্ঞা বা উল্লেখ নেই। ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘আমরা দেওবন্দে সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডো সেন্টার নির্মাণ সম্পূর্ণ করব। মিরাট, রামপুর, আজমগড়, কানপুর, বাহরাইচে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী কমান্ডো কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।’
পুরো ইশতেহারে সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় স্পষ্ট। জনগণের ইস্যুতে প্রথম দফায় যে অ-মেরুকরণ নির্বাচনের ধারা শুরু হয়েছে, তা দ্বিতীয় দফার মাধ্যমে পুরো নির্বাচনই চলবে বলে অনুমান করা যায়। নির্বাচন হবে সাত দফায়। তবে বিরোধী দলগুলোকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ যাতে একই রকম থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে ঝড় তোলা ‘খেলা হবে’ স্লোগান উত্তরপ্রদেশেও ঝড় তুলেছে ‘খেদা হৈবে’ রূপান্তরে। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, ভোটযুদ্ধ যতই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে, ততই পরিবর্তনের হাওয়া বৈশাখী ঝড়ে পরিণত হবে। বাস্তবেই তা হবে কি না জানা যাবে ১০ মার্চ।
আশিস গুপ্ত: সাংবাদিক, নয়াদিল্লি