বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভারতে হিজাব বিতর্কের নেপথ্যে কী

  • আশিস গুপ্ত    
  • ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৬:৫৯

হঠাৎ করে হিজাব নিয়ে ঝামেলা শুরু হলো কেন? যারা হিজাবমুক্ত হয়ে মুসলিম মেয়েদের স্বাধীনতার নতুন উকিল হয়েছেন, তারা কারা? হিজাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেরুয়া পরার প্রয়োজনীয়তা কে অনুভব করেছিল? সতর্কভাবে দেখলে চোখে পড়বে কীভাবে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে কর্ণাটকে বিজেপি তার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কার্ড খেলতে শুরু করেছে।

২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, সব নারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মচারীদের অবশ্যই একটি ইসলামিক আবায়া পোশাক এবং নেকাব পরতে হবে, যা চুল, শরীর এবং মুখের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে। পোশাকের রং হবে কালো এবং নারীদের অবশ্যই তাদের হাত ঢেকে রাখার জন্য গ্লাভস পরতে হবে।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভারতের কর্ণাটকের উদুপি সরকারি পিইউ কলেজের শিক্ষার্থী আলিয়া আসাদি লিখেছেন: ‘আমি হিজাব নিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। হিজাব পরার কারণে আমাদের ক্লাসরুমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এটি আমাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার হলেও তারা (কলেজ কর্তৃপক্ষ) আমাদের অনুমতি দিচ্ছে না। যদিও এটি সরকারি কলেজ। কলেজে অনেক বৈষম্য, আমরা একে অন্যের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে পারি না, কলেজে একে অন্যকে সালাম বলতে পারি না। বিষয়টি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে এবং এতে আমরা খুবই দুঃখিত। এটি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠুক আমরা তা কখনই চাইনি।’

ভারতের দক্ষিণী রাজ্য কর্ণাটক সম্প্রতি উত্তাল হিজাব বিতর্কে। বিতর্কের সূত্রপাত জেলা সদর উদুপি শহরে সরকারি পিইউ কলেজে হিজাব পরা মেয়েদের ক্লাস থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে। কেন মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে স্কুল-কলেজে আসছে, তা নিয়ে মাসখানেক ধরে বাজার গরম করতে শুরু করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। কেন মুসলিম সহপাঠীরা হিজাব পরে আসবে, তার প্রতিবাদে গেরুয়া চাদর গায়ে স্কুল বা কলেজে এসেছে অন্য পড়ুয়ারাও।

উত্তেজনার পারদ যখন চড়তে থাকে, হিজাব পরে আসা ছাত্রীদের স্কুলে বা কলেজে ঢুকতে দেওয়া হলেও অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা ক্লাসঘরে বসানো হয়। দুটি স্কুলে আবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়াতে হিজাব পরে আসা ছাত্রীদের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিতর্ক বাড়তেই থাকলে কর্ণাটক সরকার হিজাব বা ওই-জাতীয় কাপড় পরে স্কুলে বা কলেজে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

প্রশ্ন হলো: স্কুল-কলেজের ড্রেস কোডে কি সমাজের প্রবণতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকা উচিত নয়? স্কুল-কলেজে টুপি বা পাগড়ি নিষিদ্ধ করা উচিত? শিখ ছেলেদের কি স্কুলের ড্রেস কোড অনুসরণ করে পাগড়ি না পরার জন্য অনুরোধ করা হবে এবং করলে সেটি কি ন্যায়সঙ্গত হবে? অথবা যদি স্কুল কোড শিখ অনুভূতির কথা মাথায় রেখে এটি সম্ভব করে, তবে কি অন্য সম্প্রদায়ের সামাজিক অনুভূতিকেও বিবেচনা করা উচিত নয়?

হিজাব পরা একটি মৌলিক অধিকার, যা ভারতের সংবিধানের ১৪ ও ২৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চিত করা হয়েছে এবং এটি মুসলিম নারীদের ধর্ম পালনের জন্য অপরিহার্য। একে অন্যের বৈচিত্র্যকে সম্মান করার চেতনায় ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের বিকাশ ঘটেছে। এ কারণে ভারতের সংবিধানে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক জীবন থেকেও এই জিনিসটি এসেছে।

দুর্গাপূজা, গণেশোৎসব, ছট, মহরম, কানওয়ার যাত্রা– এই ধরনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে রাস্তা জ্যাম হয়, কিছু শহর থমকে যায়, কিছু কাজও থেমে যায়; কিন্তু কেউ অভিযোগ করে না। সবাই জানেন যে এটি ভারতীয় সমাজের ছন্দ। স্কুল-কলেজেও এই বৈচিত্র্য দেখা যায়। কেউ তিলক পরে, কেউ পাগড়ি বা টুপি পরে, কেউ হিজাব পরে এবং কেউ বোরকা পরে। এটিও ভারতীয় সমাজের সৌন্দর্য।

চলমান বিতর্ক রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদ মুসলিম ছাত্রদের সমর্থন করেন, অনেকে নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেন। আর এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ছে।

কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বিসি নাগেশ বলেছেন, ধর্মকে স্কুলের বাইরে রাখা উচিত এবং তিনি হিজাব নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। অথচ কর্ণাটকের স্কুল-কলেজে মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে হিজাব পরে আসছে। এটি কাউকে বিরক্ত করেনি। হঠাৎ করে হিজাব নিয়ে ঝামেলা শুরু হলো কেন? যারা হিজাবমুক্ত হয়ে মুসলিম মেয়েদের স্বাধীনতার নতুন উকিল হয়েছেন, তারা কারা? হিজাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেরুয়া পরার প্রয়োজনীয়তা কে অনুভব করেছিল?

আসলে বর্তমান ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া কাজ করছে, যা একে অপরের পরিপূরক। একটি দীর্ঘমেয়াদি, অন্যটি স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়াটি হলো ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বে’র আধারে ভারতকে ঢেলে সাজানো। আর স্বল্পমেয়াদি প্রক্রিয়াটি হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যের রাজনৈতিক খেলায় (নির্বাচন) সাম্প্রদায়িকতাকে স্ট্রাইকারের পজিশনে রেখে শাসনের কর্তৃত্ব নিজ দখলে রাখা।

২০১৪ সালের মে মাসে দিল্লির মসনদে বিজেপি আসীন হওয়ার পর থেকে দেশে ওই দুটি প্রক্রিয়া চলছে সমান্তরালভাবে। দুটি প্রক্রিয়াই ভারতের চেহারা এবং মেজাজে পরিবর্তন ঘটাতে চায়। প্রতিবাদ এবং বিতর্কের পেছনে, উপকূলীয় কর্ণাটকের রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তিরা বলেছেন, এটি হিজাব ইস্যুতে রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলা, আগামী বছরের (মে ২০২৩) বিধানসভা নির্বাচনের দিকে নজর রেখে।

রাজনৈতিক প্রভাব বোঝার জন্য ঘটনাক্রম বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালের অক্টোবরে একটি ‘ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিএফআই) ব্যানারসহ উদুপির সরকারি পিইউ কলেজে কয়েকজন মুসলিম ছাত্রের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়েছিল। ছবির সঙ্গে একটি বার্তায় লেখা ছিল- ‘এই ছাত্ররা একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। ওরা জানত না ওই প্রতিবাদের সংগঠক অখিল ভারতীয় বিদ্যা পরিষদ (আরএসএস প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন)। ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ার নেতারা আজ তাদের পরামর্শ দেওয়ার পর তারা নিজেদের ইচ্ছায় ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়েছে।’

এখানে লক্ষণীয়, ক্যাম্পাস ফ্রন্ট ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন। ক্যাম্পাস ফ্রন্টের সদস্য কিছু ছাত্র বর্তমান বিক্ষোভের অংশ। তারা জোর দিয়ে বলছেন, তাদের প্রতিবাদ রাজনৈতিক নয়, এটি তাদের মৌলিক অধিকারের লড়াই।

যা-ই হোক, হিজাব বিতর্ক একটি কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল। সেটি সিএফআই আসার পর জেলা এবং পরবর্তীকালে রাজ্যজুড়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীন বিজেপিও বিতর্কে ঢুকে পড়ে। তিনটি সরকারি কলেজের ক্ষেত্রে যেখানে হিজাব পরা শিক্ষার্থীদের ঢুকতে বাধা দেয়া হয়, সেগুলোয় কর্মকর্তাদের পরিবর্তে শাসক দলের বিধায়করা মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন। উদুপির বিজেপি বিধায়ক কে রঘুপতি ভাট পিইউ কলেজের পক্ষে কথা বললে বিজেপি বিধায়ক হালাদি শ্রীনিবাস শেঠি কুন্দাপুরের দুটি কলেজের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই ইস্যুর সঙ্গে রঘুপতি ভাটের নিজের রাজনীতির গভীর যোগ আছে। একটি কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রঘুপতি ভাট ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বিজেপির টিকিট পাননি। ২০১৮ সালে তার টিকিটের ঘোষণাও বিলম্বিত হয়েছিল। রাজ্যস্তরের এক বিজেপি নেতা বলেছেন, দল অন্য উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। ওই বিজেপি নেতা বলেন, ‘২০১৮ সালে অন্য একজন ভালো প্রার্থী পাওয়ার চেষ্টা সফল না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল।’

ভাটের জন্য সিএফআইয়ের মাধ্যমে তোলার হিজাব ইস্যু একটি সুবর্ণ সুযোগ। ২০১৩ সালে কর্ণাটকের ২৪টি আসনের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। ২০১৮ সালে হিন্দুত্বের তরঙ্গে চড়ে তারা ফিরে আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রঘুপতি ভাট সচেতন যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাকে আসনটি ধরে রাখতে সাহায্য করবে।

একই সময়ে হিজাব ইস্যুতে সাবেকে মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া এবং অন্যদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ভাট নিজেকে আগামী নির্বাচনে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এসডিপিআই এবং বিজেপির বিপরীতে এই বিতর্কটি এ অঞ্চলে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করছে। রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে জাতপাতের রাজনীতি বড় ভূমিকা পালন করে।

উপকূলীয় কর্ণাটকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আধিপত্য। শুধু ভাট নয়, এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পিঠে চড়েই নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চায় বিজেপি, যেমনটা তারা করেছিল ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিজেপির ইস্যু স্লোগান ছিল ‘গো-হত্যা নিষিদ্ধ কর।’ নির্বাচনি প্রচার চলাকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দীপ শাস্ত্রী বলেছিলেন, ‘গো-হত্যা ইস্যুটি যে বৃহত্তর এজেন্ডা উপস্থাপন করে, তা গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির জন্য এই নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো- ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে তার নীতি ও কর্মে হিন্দুবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা। লিঙ্গায়ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যু এবং গো-হত্যা নিষেধাজ্ঞা সবই বৃহত্তর হিন্দুত্ব এজেন্ডার বিকল্প পথ।’

এই প্রতিবেদন শুরু করেছিলাম দুটি উদ্ধৃতি দিয়ে। আসলে বোঝাতে চেয়েছিলাম স্থান, কাল, দেশান্তরে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ এক এবং অভিন্ন। কোথাও বোরকা, হিজাব পরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে ফতোয়া জারি যেমন অন্যায়, তেমনই অন্যায় হিজাব পরার জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে প্রবেশে বাধা দেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) তাদের ২০২১ সালের বার্ষিক রিপোর্টে ভারত সম্পর্কে বলেছে, ‘জাতীয় এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হয়রানি ও সহিংসতা সহ্য করার সঙ্গে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিস্থিতি নিম্নমুখী হয়ে উঠছে।’

দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্ক থাকলেও ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশ্লেষণ বা পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছে।

স্বাভাবিক!!

আশিস গুপ্ত, সাংবাদিক, নয়াদিল্লি

এ বিভাগের আরো খবর