অনেক বছর আগে, সেই ৭৮/৭৯ সালে আমাদের পরিচিত একটি ছেলেকে কে বা কারা এসে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ছেলেটি সেসময় কলেজে বিএ পড়ত। সাদামাটা ছেলে ছিল রাজন ভাই কিন্তু শুনেছি রাজনীতি করত। কী রাজনীতি তা জানতাম না। আর রাজনীতি করলেই কেন একটি ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে হবে, তাও বুঝতাম না।
শুধু দেখেছি রাজনের মা প্রায় প্রতিদিন আমাদের বাসায় এসে কান্নাকাটি করতেন। আব্বাকে অনুরোধ করতেন যেন ছেলের একটা খোঁজ এনে দেয়া হয়। তিনি শুধু জানতে চাইতেন তার ছেলেটা বেঁচে আছে কি না। কিন্তু অনেক খোঁজাখুজি করেও রাজন ভাইয়ের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
কেউ বলতো গুম হয়েছে, কেউ বলতো রাজন উধাও হয়ে গেছে। গুম আর উধাও হওয়ার মধ্যে ঠিক কী পার্থক্য, আমি তখনও তা বুঝতাম না। রাজনের কী হয়েছিল, আমরা পরে আর জানতে পারিনি। শুধু দেখেছি ওর মায়ের কান্না। শুনেছি বিলাপ। তারপর একদিন আটপৌরে শাড়ি পরা ওই মা হারিয়ে গেলেন। আর এলেন না আমাদের বাড়ি। আমরাও ভুলে গিয়েছিলাম।
এরও আগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের অনেকের খোঁজ আমরা আজও পাইনি। যতদূর জানি সেসব পরিবারের মানুষ এখনও একটা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন, তাদের প্রিয়জন হয়তো একদিন ফিরে আসবেন। হারিয়ে যাওয়া অনেককে খুঁজে পেয়েছি রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। জহির রায়হানের মতো মহাপ্রাণ মানুষ এই স্বাধীন দেশ থেকে হারিয়ে গেছেন। এসব হারিয়ে যাওয়ার কোনো হিসাব মেলানো যায় না। শুধু ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলো স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে।
শুধু গুম বলছি কেন, পরিবার থেকে কেউ উধাও বা নিখোঁজ হয়ে গেলেও মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। প্রিয়জন কোথায় গেল, কেন গেল, কার সঙ্গে গেল, বেঁচে আছে কি না, বেঁচে থাকলে কেমন আছে এসব প্রশ্নে দিশাহারা থাকে সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষের পরিবার।
আব্বার কাছে শুনেছি আমাদের পরিবারের একজন চাচা বিয়ের কিছুদিন পরেই নিখোঁজ হয়ে যান। ওনাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো। সেই ৬০/৭০ বছর আগের কাহিনি। নবপরিণীতা বধূ অর্থাৎ আমার চাচি হতভম্ব হয়ে গেলেন। কেউ বলল চাচাকে মাজারে দেখা গেছে, কেউ বলল বাজারে, কেউ বলল বাউলদের দলে, কেউ জানাল কাকরাইল মসজিদে তবলিগের দলে- কিন্তু চাচা আর ফিরে আসেননি।
আমার দাদা নিজ উদ্যোগে ছেলের বউকে পড়াশোনা শেখালেন এবং বিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু চাচি বলেছিলেন,‘বাবা আপনার ছেলে যদি ফিরে আসে, তখন আমাকে না পেলে কষ্ট পাবে।’ এরপর আরও বহু বছর চলে গেছে, চাচি মেয়েদের কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে রিটায়ার করেছেন এবং এরও ৬/৭ বছর পর মারা গেছেন। কিন্তু সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটি আর ফিরে আসেননি।
সন্তান-স্বামী, বাবা-মা বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য হারিয়ে যাওয়া, নিখোঁজ হওয়া বা গুম হওয়ার পর সেই পরিবারের গল্পগুলো একই হয়। প্রিয়জন হারানোর চাপ তাদের বইতে খুব কষ্ট হয়। মানুষটি মারা গেছে এবং পরিবার তাকে মটিতে শুইয়ে দিয়েছে বা দাহ করেছে, এটাও অনেক শান্তির। কিন্তু মানুষটি ‘নাই’ হয়ে গেছে এই কষ্ট যেন তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার যন্ত্রণার চেয়ে বেশি।
২০২০ সালে ডয়েচে ভেলের এক খবরে বলা হয়, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের বড় একটি অংশই আর ফিরে আসেননি। তারা আদৌ আর কখনও ফিরে আসবেন কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুয়ায়ী ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন এর কোনো তথ্য নেই পরিবারের কাছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারছে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, র্যাব, ডিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে বিভিন্ন সময়ে ওই ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও অতি সম্প্রতি বলেছেন, দেশের নিরাপত্তা বাহিনী গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। বিভিন্ন আত্মগোপনের ঘটনাকে গুম বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে কেউ গুম হয় না। যেখানেই গুম হচ্ছে, সেখানেই আমরা কিছু দিন পরেই তাকে পাচ্ছি। নানা কারণে আত্মগোপন করে থাকে, সেগুলোকে গুম বলে চালিয়ে দেয়। দু’একটি আত্মগোপনের ঘটনার তথ্য আমরা এখনও পাইনি। আমরা মনে করি, তাদের অচিরেই সামনে এনে দিতে পারব।
অথচ যে পরিবারের সদস্যরা গুম হয়েছেন বা যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা কেউ মানতে রাজি নন যে, তাদের প্রিয়জন আত্মগোপন করে আছেন। বছরের পর বছর ধরে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য পরিবারে স্ত্রী-মা, বোন-বাবা, সন্তান অপেক্ষা করে আছেন। এরা যে সবাই রাজনৈতিককর্মী বা ভিন্নমতাবলম্বী তা কিন্তু নয়। অনেকে ব্যবসায়ী, কেউ কেউ ছাত্র, কেউ চাকরিজীবী।
বেশ পরিচিত কেউবা হাই প্র্রোফাইল বা রাজনৈতিক নেতারা উধাও হয়ে গেলে চারদিকে খানিকটা নড়াচড়া দেখা যায়, এরপর সব সুনসান। যেমন বিএনপি নেতা ইলিয়াস, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ফরহাদ মজহারের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে খুব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।
আসক বলেছে, ২০২১ সালে ৭ জনকে অপহরণ করা হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়েছে। জানি না এরা কোথায়? কবে ফিরে আসবেন? পরিবারগুলো বলেছে ফিরে আসার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাদের।
আসকের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কাউকে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ‘ক্রসফায়ারে’ তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রে নিখোঁজ থাকার সময় কী ঘটেছে তাও জানা যায় না। মাঝেমাঝে থানাও মামলা নেয় না। আদালতে মামলা করতে হয়েছে। অনেকে তদন্ত রিপোর্টও পুরো পাননি। অনেক মামলার প্রথমদিকে পুলিশের আগ্রহ থাকলেও পরে আর কিছু আগায়নি। এর মানে পুরো বিষয়ই একটা ধোঁয়াশাই থেকে যায়।
এদিকে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা নতুন করে অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করছে। তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। উধাও হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা আসলেই গুম হয়েছেন কি না, তা জানতে চাইছেন। পুলিশ নিজেদের মতো করে লিখে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে রেখে দিচ্ছে। এমনকি তারা গুম হননি, আত্মগোপনে চলে গিয়েছেন, এমন কিছু লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
দেশের দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কটি পরিবার অভিযোগ করেছে, নিখোঁজ স্বজনদের সম্পর্কে তথ্য গোপন করে ইচ্ছাকৃতভাবে কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করেছেন ‘স্বীকার করে’ আগে থেকে লেখা বিবৃতিতে সই করতে পুলিশ তাদেরকে বাধ্য করেছে।
গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং কমিটির ১২৬তম বৈঠক ৭ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে অনেকের সঙ্গে গুমের অভিযোগ, প্রক্রিয়াগত বিষয় এবং গুমের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা হবে।
আমরা জানি না বাংলাদেশ জাতিসংঘের এই বৈঠকে উত্থাপিত প্রশ্নের কী জবাব দেবে? যা-ই উত্তর দিক না কেন, শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যেন বলে না বসেন, জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গুমের তালিকায় যে লোকজনের নাম দিয়েছিল, তাদের অনেকের ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি হয়েছে। সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমনটা বললে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা একদিকে দেখছি হারিয়ে যাওয়া বা গুম হয়ে যাওয়া কিংবা আত্মগোপনে থাকা মানুষগুলোর পরিবারের অসহায় অবস্থা, অন্যদিকে মন্ত্রী বলছেন এই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অনেকেরই সলিলসমাধি হয়েছে। তাহলে কি আমরা ধরে নেব এসব পরিবারের যে বাবা-মা সন্তানকে দেখতে না পেরে অসুস্থ হয়ে মারা যান, যে স্ত্রীরা সন্তান কোলে নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন, যে ভাইবোনেরা একসঙ্গে হলেই হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের গল্প করে, সেগুলো সব মিছে আশা ।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন