মাতৃত্বেই নারীত্ব এমন পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলো ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। সমাজের এই চিরাচরিত রক্ষণশীল ধারণা যেমন পাল্টাচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে মেডিক্যাল সায়েন্স। বিজ্ঞান আজ প্রায় সব অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলছে। নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী কোনো উপহার বললে ভুল হবে না। তবু সারোগেসি কি সবার জীবনে আশীর্বাদ? সারোগেসির অন্ধকার দিকটুকু কি একেবারেই অবিবেচ্য? কতটুকু মানবিক সন্তান জন্মদানের এই যুগান্তকারী পদ্ধতি?সম্প্রতি সারোগেসি পদ্ধতিতে মা-বাবা হয়েছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নিক জোনাস দম্পতি। এবারই প্রথম নয়। এর আগেও অনেক তারকা সারোগেসি পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন দম্পতি হিসেবে আবার সিংগেল বাবা মা হিসেবেও। কিম কারদাশিয়ান ও তার প্রাক্তন স্বামী সারোগেসির সাহায্যে মা-বাবা হয়েছিলেন। বলিউডেই এক ঝাঁক তারকার মধ্যে শাহরুখ-গৌরী, আমির-কিরণসহ আরও অনেকে সন্তানসুখ পেয়েছেন একইভাবে। সারোগেসি পদ্ধতিতে সিংগেল বাবা হন করণ জোহর।নীল প্যাট্রিক হ্যারিস ও ডেভিড বার্টকারসহ আরও অনেক সমকামী তারকা সারোগেট মায়ের সাহায্যে বাবা হয়েছেন।আর্থিকভাবে স্বচ্ছল সাধারণ মানুষের মধ্যে সারোগেসি এখন আর অপ্রচলিত নেই।
কিন্তু যে সারোগেট মায়ের জরায়ুতে বেড়ে উঠেছে এই শিশুরা, সেই মায়েদের গল্প কি কেউ কখনো শুনতে চায়?মাতৃত্বের চুক্তি!মাতৃত্বের বেচাকেনা এই শতাব্দীর এক অনন্য আবিষ্কার বটে, সঙ্গে নিষ্ঠুর সত্যও বৈকি। ধনী-গরীবের ক্রমশ বেড়ে চলা এই তফাতের পৃথিবীতে যেখানে একজন নারী নিজের শরীরের অধিকার নিজেই নিচ্ছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি সন্তান জন্ম দেবেন কি দেবেন না, সেখানে অর্থের বিনিময়ে সন্তান ধারণের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক কষ্ট ভোগ করে অন্যের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করছেন নারী। অর্থনৈতিক বৈষম্য না থাকলে কি সারোগেসির মতো পদ্ধতির অস্তিত্ব থাকা সম্ভব?
মানছি, পুরোটাই নারীর অধিকার, স্বাধীনতা; কেউ জোর করছে না কাউকে। তবু প্রশ্ন করতে হয়, কেন মাতৃত্বের এই তীব্র শারীরিক কষ্ট কিছু অর্থের বিনিময়ে স্বীকার করতে রাজি হন এই নারীরা?
কথায় বলে, একজন মায়ের ২০টা হাড় ভাঙার ব্যথার সমপরিমাণ যন্ত্রণা পেতে হয় সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়। শারীরিক কষ্টের সঙ্গে যুক্ত থাকে মানসিক চাপ। আর যে-কোনো গর্ভাবস্থায় মৃত্যুঝুঁকি তো রয়েইছে। অথচ এই সন্তানের ওপর আইনি কোনো অধিকার তাদের থাকে না। ‘সারোগেট মাদার’ বলা হয় কেবল নামেই, সন্তান জন্ম দিয়েই যার মুক্তি!‘ট্রু সারোগেসি’ পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বানু নিয়ে ল্যাবে প্রক্রিয়াকরণ করে ভ্রূণ তৈরি করা হয় এবং সারোগেট মায়ের গর্ভে স্থাপন করা হয় ভ্রূণটি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেই সন্তানের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক থাকে না জন্মদাত্রীর। এই নয় মাসে নিজের গর্ভে বেড়ে ওঠা ছোট্ট প্রাণটির সঙ্গে নিবিড় কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার এখতিয়ার নেই মায়ের।অর্থের বিনিময়ে নিজের গর্ভ ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্তটা তাই খুব সহজ হওয়ার কথা নয়। নিজের সম্মতিতে অন্যের সন্তান গর্ভে ধারণ করলেও এই সম্মতির পেছনের গল্প আদতে এ পৃথিবীতে বেড়ে চলা আর্থিক ও সামাজিক অসংগতির। আর এমনিতেও কোনো অর্থমূল্য কি সন্তান জন্মদানের পুরো অভিজ্ঞতার সমতুল্য হতে পারে? নিজের বংশানু বা জিন বহন করা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ না করলেও নিশ্চয়ই মা হওয়া যায়, এবং চমৎকার মা-ই হওয়া যায়। কিন্তু সেই একই প্রসঙ্গে এই প্রশ্নও এসে যায়, কেন নিজেদের ঔরসজাত সন্তানেরই মা-বাবা হতে চায় মানুষ?ইউনিসেফের সমীক্ষা বলছে, বিশ্বজুড়ে ১৫ কোটি ৩০ লাখ অনাথ শিশু আছে। পিতৃমাতৃহীন এ শিশুরা কেউ কেউ বিভিন্ন এনজিওতে মানুষ হচ্ছে। আর বাকিরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে শিশুশ্রমিক হিসেবে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা, একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন এদের কাছে পরের জন্মের জন্য তুলে রাখা স্বপ্ন।তবু সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে এখনও আগ্রহ সামান্যই। অন্যের ঔরসজাত সন্তানকে ‘নিজের’ বলে ভাবতে পারার মতো ‘মহানুভবতা’ এখনও পৃথিবীজুড়ে খুব বেশি মানুষ দেখাতে পারেনি।এর পেছনের কারণ নিয়ে ভাবতে গেলে মনে হয় এটাও মানুষের অমরত্বের প্রত্যাশার একটা অংশ। ঔরসজাত সন্তানের মধ্য দিয়ে নিজের বংশানু রেখে নিজেকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায় মানুষ। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে নিজের বৈশিষ্ট্য সঞ্চারণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠা মানুষ তাই অনাথ শিশুকে দত্তক নেওয়ার চাইতে সারোগেসির মাধ্যমে নিজের শুক্রাণু ডিম্বাণু থেকে সৃষ্ট ভ্রূণকেই পৃথিবীতে আনার পক্ষে। এতে হয়তো অন্যায় কিছু নেই, ঠিকই। তবু কোথাও না কোথাও, কিছুই কি অসুন্দর নেই?এদিকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি-ব্র্যাড পিট, টম ক্রুজ-নিকোল কিডম্যানের মতো অসংখ্য তারকা দম্পতি সন্তান দত্তক নিয়ে অসাধারণ বাবা-মা হয়ে পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছেন শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় এমনটা নয়। সুস্মিতা সেন এবং ম্যাডোনার মতো সফল নারীরাও প্রমাণ করেছেন, তাদের নিজেদের শরীরের কিংবা জিনের অংশ না হয়েও কীভাবে তাদের দত্তক নেওয়া সন্তানেরা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে।আইনত সারোগেসির বিরোধিতা করার কোনো যুক্তি এখনও নেই। নিজের শরীরে অন্য কারোর সন্তান লালন-পালন করতে দেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত সারোগেট মা নিজেই নেন। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় অন্য আর সবকিছুর মতোই এই ‘নিজের’ ভেতর কতটুকু সত্যিই নিজের আর কতটুকু জীবনের বা অভাবের চাপিয়ে দেওয়া সেটুকুই ভাবনার বিষয়!
শর্বাণী দত্ত: লেখক, সাংবাদিক