বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাণিজ্য মেলা, করোনা ও লেখাপড়া

  •    
  • ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ১৫:০৭

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, করোনায় সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হয়েছে শিক্ষা খাত। যখনই বিধিনিষেধ বা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, শুরুতেই কোপ পড়েছে পড়ালেখায়। বলা হচ্ছে, অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হচ্ছে।

ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডে যেদিন (২২ জানুয়ারি) থেকে করোনার অধিকাংশ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার শুরু হলো, তার ঠিক আগের দিনই করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেইসঙ্গে দেয়া হয় ১১টি বিধিনিষেধ। অথচ গত সপ্তাহেও আয়ারল্যান্ড ছিল ইউরোপে সর্বোচ্চ করোনা আক্রান্তের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়।

শুধু আয়ারল্যান্ড নয়, পুরো ইউরোপ শুরু থেকেই করোনায় নাস্তানাবুদ হয়েছে। তারা যখন বিধিনিষেধ শিথিল এবং কোথাও কোথাও পুরোপুরি প্রত্যাহারের পথে হাঁটছে, তখন বাংলাদেশকে নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করতে হচ্ছে। ফের লকডাউনের শঙ্কা না থাকলেও পরিস্থিতি যে খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে, সে কথা খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেও স্পষ্ট। উপরন্তু দেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নানারকম কন্ট্রাডিকশন বা সাংঘর্ষিক অবস্থাও পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলছে বলে প্রতীয়মাণ হচ্ছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধের ঘোষণা দিলেন, সেদিনই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাণিজ্য মেলা চলবে। বাণিজ্য মেলার পরিচালক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, মেলা বন্ধের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনও নতুন নির্দেশনা আসেনি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। মাস্ক না পরা ও স্বাস্থ্যবিধি ভাঙলে জরিমানাও করা হচ্ছে।

এর পরদিনই, অর্থাৎ শনিবার চলমান পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা। সকাল ৯টার পর থেকে তারা রাস্তায় অবস্থান নেয়। ওইদিনই তারা শেষ পরীক্ষাটি দিতে কেন্দ্রে এসেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে জানতে পারে, পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যেহেতু এটি শেষ পরীক্ষা, সুতরাং করোনা বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে এটি স্থগিত রাখার কোনো মানে নেই। কারণ একবার স্থগিত হয়ে গেলে এটি আবার কবে নেয়া হবে, তা কেউ বলতে পারে না। উপরন্তু ওই একটি পরীক্ষার জন্যই এই শিক্ষার্থীদের ফলাফল পেতে বিলম্ব হবে।

শুধু এ একটি ঘটনাই নয়, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, করোনায় সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হয়েছে শিক্ষা খাত। যখনই বিধিনিষেধ বা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, শুরুতেই কোপ পড়েছে পড়ালেখায়। বলা হচ্ছে, অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, ফিজিক্যাল ক্লাস-পরীক্ষা আর অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার মধ্যে যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল, সেটি শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা জানেন। শিক্ষকরা তো বটেই। অনলাইন ক্লাস মূলত ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো’। এর একটি বড় কারণ, অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই অনলাইন ক্লাস করার মতো উন্নত ডিভাইস এবং নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট কানেকশন নেই। অনেকে ক্লাস শুরু করে ভিডিও অফ করে রাখেন। কেউ কেউ অডিও-ভিডিও দুটিই অফ করে অন্য কাজ করেন। সব মিলিয়ে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে পড়াশোনা ফাঁকি দেয়ার একটি বিরাট হাতিয়ার।

তাহলে করণীয় কী ছিল? বলা হচ্ছে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।’ অর্থাৎ একেবারে ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ার চেয়ে অনলাইন বেটার। কিন্তু আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সংস্কৃতি এখানে বিরাট অন্তরায়। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষকদের চেষ্টা নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই বিকল্প উপায়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা আসলে কতটা হয়েছে, হচ্ছে বা হবে— তা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে সংশয়ের অন্ত নেই। দুর্ভাগ্য, যখনই শারীরিকভাবে উপস্থিতিতে ক্লাস চালু শুরু হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিল, তখনই নতুন করে চোখ রাঙাতে শুরু করে করোনাভাইরাস। ফলে সরকারকে নতুন করে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিতে হয়।

এখানে অবশ্য কিছু কন্ট্রাডিকশন বা সাংঘর্ষিক অবস্থাও দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও বাণিজ্যমেলা ঠিকই চলছে—যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় এবং অনেকেই যে এরকম ভিড়ের মধ্যে গিয়েও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে মাস্কও পরছেন না— এমন ছবিও গণমাধ্যমে আসছে। তার মানে কি বাণিজ্যমেলায় করোনার শঙ্কা কম?

অনেকে মনে করেন, মেলা যেহেতু খোলা জায়গায় হচ্ছে, ফলে এখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কম। যদি তাই হয়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কী প্রয়োজন ছিল? যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বড় মাঠ বা খোলা জায়গা আছে, সেখানেও বেঞ্চ পেতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া সম্ভব। কিন্তু এই বিকল্প ভাবনাটি আমাদের নীতি-নির্ধারকদের মগজে আসতে চায় না। কারণ তারা সম্ভবত মাথাব্যথা হলে মাথাটি কেটে ফেলার পক্ষে।

ফিজিক্যাল ক্লাস-পরীক্ষা চালুর জন্য অনেক বিকল্প প্রস্তাবও এসেছিল। যেমন একসঙ্গে ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে হাজির না করে দুই বা তিনটি শিফটে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস চালু করা। সব ক্লাসের নির্ধারিত ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, পড়ালেখা ছাড়া সবই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। রাস্তায় বা বাজারে গেলে মানুষের ভিড় এবং মাস্কবিহীন মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব একটি অতিমারির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

যদি তাই হয়, তাহলে বিধিনিষেধেরইবা দরকার কী? মানুষ যদি মনে করে এই পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে; জ্বর-সর্দি-কাশি হলেও যদি তারা যদি মনে করে যে, এই পরিস্থিতি নিয়েও তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাবে; সেটিও বরং বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক কম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের জন্য ভালো। কারণ দিনের পর দিন আর্থিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলে তার পরিণাম করোনার চেয়েও খারাপ হবে।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে জাতির জন্য সঠিক দিকনির্দেশনার যে ঘাটতি রয়েছে তা শুরু থেকেই দৃশ্যমান। যেমন একবার বলা হলো- হোটেল রেস্টুরেন্টে খেতে হলে সঙ্গে টিকাকার্ড থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই কার্ড কে পরীক্ষা করবে? রেস্টুরেন্টের মালিক? তার কী দায় পড়েছে! কার্ড দেখে কাস্টমার প্রবেশ করালে তার ব্যবসা লাটে উঠবে। তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? দেশে কি এত পুলিশ আছে যে সারা দেশের হোটেল রেস্টুরেন্টে গিয়ে তারা কাস্টমারদের কার্ড পরীক্ষা করবে? এরপরে বলা হলো- সামাজিক অনুষ্ঠানও চলবে, তবে একশ লোকের বেশি নয়। প্রশ্ন হলো- সেখানে একশ লোক আছে নাকি একশ দশজন, সেটি কে গুণে দেখবে?

তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, যদি বাণিজ্যমেলা চলতে পারে, যদি সর্বোচ্চ একশ লোক নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান হতে পারে, যদি প্রতিটি বাস ও লঞ্চে এখনও গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হতে পারে, তাহলে শুধু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হবে কেন? করোনার ঝুঁকি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে?

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এবং শত শত ইউনিয়ন পরিষদেও ভোট হয়ে গেল যেখানে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছে। সেখানে করোনা ছড়ায়নি? বার বারই কেন পড়ালেখাই ভিকটিম হবে? বাঙালির প্রাণের মেলা, অমর একুশে বইমেলাও নির্ধারিত সময় অর্থাৎ পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে না। এটি নাকি ১৫ তারিখ শুরু হবে। প্রশ্ন হলো ১৫ তারিখের মধ্যে দেশ থেকে করোনা উধাও হয়ে যাবে? বার বার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বইমেলার মতো মননশীল আয়োজনের মধ্যেই কেন বিধিনিষেধ? যে ‍যুক্তিতে বাণিজ্যমেলা চলছে, সেই যুক্তিতে বইমেলা কেন পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করা যাবে না? কাদের মাথা থেকে এসব চিন্তা বের হয়?

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর