বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শাবিপ্রবির চলমান বাস্তবতা অনাকাঙ্ক্ষিত

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২১ জানুয়ারি, ২০২২ ১৫:৪৩

ছাত্র আর শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ছিল: যে বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যার চর্চা হয়। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ দাঁড়িয়েছে- যেখানে বিশ্ববিদ্যা লয়প্রাপ্ত হয়!

আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য মেনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী যৌক্তিক দাবি-দাওয়া নিয়েই আন্দোলন শুরু করেছিল। এর মধ্যে প্রধান দাবি ছিল- নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের প্রতি বিরূপ আচরণ শুরু করে। বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে আবাসিক ছাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। এতে আন্দোলনকারীরা অন্যান্য দাবির সঙ্গে তার পদত্যাগ দাবিও জুড়ে দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের উপেক্ষা দেখাতে থাকে, এদিকে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ ততই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রথমে ছাত্রলীগ, পরে পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমন করার চেষ্টা করা হয়। শক্তি প্রয়োগ করেও কোনো রকম কূলকিনারা করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে শিক্ষার্থীরা চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। তারা হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় না ছাড়ার ঘোষণা দেয়। তারা ভিসি ও প্রক্টরের বাড়িতে তালা লগিয়ে দেয় এবং ভিসির পদত্যাগের দাবিতে অনড় অবস্থান গ্রহণ করে।

এর মধ্যে ছাত্রীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অত্যন্ত নেতিবাচক ও আপত্তিকর মন্তব্যসংবলিত একটি অডিও ভাইরাল হওয়ার পর পরিস্থিতি একেবারেই বদলে যায়। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে ভিসির ভূমিকা নিয়ে সবাই সমালোচনামুখর হয়। সবার অভিযোগ, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে শুরুতেই যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হতো, তাদের কথা শুনত, তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিত, তাহলে পরিস্থিতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত হতো না।

এখন রাজনৈতিক নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও প্রতিবাদকারীদের শান্ত করতে পারেননি। করোনা মহামারির কারণে এমনিতেই আমাদের দেশে প্রায় দুই বছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এখন করোনাভাইরাসের চরম সংক্রমণের লগ্নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে যদি শিক্ষা কার্যক্রম আবার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এর দায় কে বহন করবে?

বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতেই পারে। কিন্তু তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, দাবি-দাওয়াগুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা এমন কোনো কঠিন দাবি তোলেনি যা মানা যায় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে। সবচেয়ে খারাপ কাজ করেছে ছাত্রলীগ এবং পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীদের শায়েস্তা করার পথ অবলম্বন করে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেই দায় নিতে হবে।

ভিসি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তি। তিনি যদি তার শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে না পারেন, হলে এবং ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে তার যোগ্যতা ও সক্ষমতায় ঘাটতি আছে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে গত দুই দশকে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন, উপাচার্য আর পুলিশ একাকার হয়ে গেছে। সরকারি দলের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল-সন্ত্রাস, বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ছাত্রী নিপীড়নসহ নানা অপকর্মের সূতিকাগার হয়ে উঠেছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়।

অপকর্মকারীরা সব সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠলেই নেমে আসে দমন-পীড়ন-নির্যাতন। তখন পুলিশ এসে অপকর্মকারীদের প্রটেকশন দেয় আর প্রতিবাদীদের ঠেঙিয়ে শায়েস্তা করার চেষ্টা করে। আর উপাচার্য হয়ে ওঠেন এসব কু-নাট্যের নাট্যকার! সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। এটাই তার দায়িত্ব। অথচ এখনকার অধিকাংশ উপাচার্য সেই কাজটি করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর শিক্ষকরাও কম সরেস নয়। তারাও উপাচার্যকে নানাভাবে মদত জুগিয়ে যান। উপাচার্যের পাশাপাশি শিক্ষকদের ভূমিকাও পুনর্মূল্যায়ন করে দেখার সময় এসেছে।

সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, সমাজের অগ্রসর ও ‘শ্রেষ্ঠ মানুষ’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। সঠিক দিকনির্দেশনা দেবেন। হিংসায় উন্মত্ত, ক্ষমতার নেশায় বিভোর, স্বার্থোদ্ধারের চেষ্টায় যখন সমাজের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাকুল, তখন ক্ষুদ্রতামুক্ত লোভ-মোহ-সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রুখে দাঁড়াবেন। সাধারণ মানুষকে পথ দেখাবেন।

দেশের অন্যত্র যা-ই ঘটুক, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে কোনো অন্যায়, পক্ষপাত, নীতিগর্হিত কাজ তারা হতে দেবে না। এ জন্য প্রয়োজনে তারা বুকের রক্ত দেবে। প্রাণ উৎসর্গ করবে। যুগে যুগে আমাদের সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাই করেছে। ন্যায়ের জন্য, অধিকারের জন্য, শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কখনও তারা কুণ্ঠিত হননি।

এখন দিন বদলে গেছে। সমাজের সার্বিক অধঃপতন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও গ্রাস করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এখন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই লোভী, ধান্দাবাজ ও হিংস্র হয়ে উঠছেন। স্বার্থোদ্ধার, সুবিধা আদায় আর ধান্দাবাজিতে তারা অনেকে এখন অধম হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানে নির্লোভ-নির্মোহ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার জ্ঞানতাপস– এই ধারণা এখন আমূল বদলে গেছে। আর দশজন সুবিধাবাদী নষ্ট মানুষের সঙ্গে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পার্থক্য করা কঠিনতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে!

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধানও তেমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে। এই বিধি অনুযায়ী দলবাজির মহড়ায় পাস না করলে নিয়োগ-বদলি, প্রমোশন ইত্যাদি পাওয়া যায় না। এ ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অসন্তুষ্ট বলেও মনে হয় না। তারা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পদ-পদবি, সামান্য একটু সুযোগ-সুবিধা এবং প্রমোশনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। এ জন্য তারা দলবাজিই শুধু নয়, ‘অশিক্ষিত’ ‘অর্ধশিক্ষিত’ রাজনৈতিক নেতাদের পা চাটতেও কুণ্ঠিত হন না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা– অবশ্য সবাই নয়, তবে বেশির ভাগই দলবাজি নিয়ে মত্ত থাকেন, একটু সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবি, প্রমোশনের ধান্দায় সারাক্ষণ ব্যস্ত সময় কাটায়।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, আত্মমর্যাদা-আত্মসম্মান, নীতিনৈতিকতা-আদর্শ ভুলে একশ্রেণির শিক্ষক অধ্যাপক-প্রক্টর, বিভাগের প্রধান, অনুষদের ডিন, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ইত্যাদি পদ বাগাতে রাজনৈতিক দলের প্রতি ‘লেজ নাড়তে’ থাকেন। তাদের অনেকে শাসক দলের ‘গৃহভৃত্য’ হতেও কোনো গ্লানি বা অনুশোচনা বোধ করে না। অধঃপতনের এ এক চূড়ান্ত অবস্থা! শিক্ষক রাজনীতির নামে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এমন ‘বাঁদরের সার্কাসই’ চলছে।

এভাবে একটি দেশ, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। এখানে শিক্ষকদের কোনো জবাবদিহি আছে কি? বছরে কটা ক্লাস নেন, কটা বই লেখেন, কটা আর্টিকেল পাবলিশ করেন, বিদেশি জার্নালে তাদের কটা লেখা প্রকাশিত হয়– এসব নিয়েই একজন শিক্ষকের পরিচয়। এসবের হিসাব কি কেউ নেয়? সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, প্রশাসন– কেউ কি এসবের খবর নেয়?

ছাত্র আর শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ছিল: যে বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যার চর্চা হয়। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ দাঁড়িয়েছে- যেখানে বিশ্ববিদ্যা লয়প্রাপ্ত হয়!

বেশ কয়েক বছর আগে একজন প্রবাসী গবেষক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুরবস্থা ঘোচানোর জন্য কিছু উপায় বাতলেছিলেন। এগুলো হচ্ছে:

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন অনির্বাচিত পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি কোনোক্রমে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবেন না; উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সমর্থক হবেন না; সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে উপাচার্য বদল হবেন না। কাজ করবেন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য; ডিন হবেন এক বছরের জন্য, একেকটা বিভাগ থেকে রোটেশনের মাধ্যমে। নির্বাচন হবে না; বিভাগের সবচেয়ে সিনিয়র তিন-চারজন শিক্ষক রোটেশনের মাধ্যমে বিভাগের সভাপতি হবেন। প্ল্যানিং কমিটিতে থাকবেন তারাই। বিভাগের সম্প্রসারণ দরকার আছে কি না, তারাই তা ঠিক করবেন; বিভাগের শিক্ষকসংখ্যা এমন হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষক সপ্তাহে গড়ে সাত-আটটি লেকচার দিতে বাধ্য হন এবং সমানসংখ্যক টিউটরিয়াল ক্লাসও নেন; শিক্ষকেরা যাতে গবেষণা করার সুযোগ পান, তার জন্য প্রতি তিন বছর পরে এক বছর গবেষণা-ছুটি পেতে পারেন; চাকরির উন্নতির ক্ষেত্রে সত্যিকার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। খবরের কাগজে প্রকাশিত লেখা গবেষণামূলক বলে গণ্য হবে না; দ্বিতীয় পরীক্ষক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হতে হবে।

নম্বরে দশের বেশি পার্থক্য থাকলে তৃতীয় পরীক্ষক উত্তরপত্র পরীক্ষা করবেন; ব্যাঙের ছাতার মতো যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে, তাদের সংখ্যা কমাতে হবে; মান যাচাই করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দিতে হবে; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতার দ্বিতীয় পরীক্ষক হবেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষকেরা; বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা থাকতে পারবে না।

এমন আরও অনেক সুপারিশই করা যায়। কিন্তু আপাতত উল্লিখিত সুপারিশগুলো পালন করলে কিছুটা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আমাদের দেশে এসব সুপারিশ কে বিবেচনায় নেবে, কে-ইবা বাস্তবায়ন করবে?

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা-প্রবন্ধকার ও রম্য লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর