করোনার ঢেউ সহসা বন্ধ হচ্ছে না। একটার পর একটা আসছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের হাত ধরে গত ৩ জানুয়ারি থেকে দেশে দৈনিক শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় পাঁচ মাস পর ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
১১ দফার মধ্যে অন্যতম হলো- ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা এবং রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে টিকার সনদ দেখানো। সেইসঙ্গে উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়। সরকারিভাবে বলা হয়েছে এসব বিধিনিষেধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—মহামারি থেকে সুরক্ষার জন্য জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা। করোনার সংক্রমণ দ্রুত ছড়ানো ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য গণপরিবহনে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন। প্রাত্যহিক জীবনে হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজ করার অভ্যাস চালু রাখা।
সরকারঘোষিত ১১ দফা নির্দেশনা করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও এগুলো আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।সরকারি ঘোষণা ও বাস্তবতার মধ্যেই রয়েছে অনেক স্ববিরোধিতা। বাণিজ্য মেলা চলছে, পিঠা উৎসব চলছে, রাজনৈতিক সমাবেশ চলছে, নির্বাচন চলছে— এটা স্পষ্টতই ১১ দফার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বাণিজ্য মেলাকে আরও সফল করার জন্য, আরও জনসমাগম বাড়ানোর জন্য আয়োজন হচ্ছে, প্রচারণা হচ্ছে। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাণিজ্য মেলা চলবে- বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাণিজ্য মেলা কি খোলা রাখা সম্ভব? আর স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছে কি না, সেটাইবা নিশ্চিত করবে কে?
টিকার সনদ দেখিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার বিষয়ে সরকার যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সেটাও অবাস্তব এক প্রস্তাব। মানুষ কি টিকার সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরবে? আর এ ব্যাপারে তদারকিইবা কে করবে?
১১ দফা প্রস্তাব শেষ বিচারে কাগুজে ঘোষণা ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। কারণ এই ১১ দফা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, কে বাস্তবায়ন করবে, কে তদারকি করবে— তার কোনো নির্দেশনা নেই। এমন ঘোষণা বা বিধিনিষেধ অতীতেও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। তদারকির ব্যবস্থা না থাকলে সে নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয় না। তা ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে একটা সমন্বিত, সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। জনমানুষের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। কিন্তু তেমন কিছু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।
সরকার যা বলছে, যা করছে, তা যেন কেবলই করার জন্য করা। তা না হলে গণপরিবহনে সক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের মতো অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে কেন? আর ঘোষণা দেয়ার পর আবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরেইবা আসবে কেন? দোকান-পাট, অফিস-আদালতসহ মানুষের রুটি-রুজির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু খোলা রেখে শুধু গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত কোন যুক্তিতে গ্রহণ করা হয়েছিল? এমনিতেই আমাদের দেশে গণপরিবহনের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
সেখানে যদি অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচলের নিয়ম করা হয়, তাহলে মানুষ গন্তব্যে পৌঁছবে কীভাবে? বড়লোকদের নিজস্ব পরিবহন আছে। তাদের জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোমসহ নানা সুবিধা আছে। এমনকি সপ্তাহের প্রতিদিন তাদের বাইরে বের না হলেও চলে। কিন্তু দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই সুযোগ নেই। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের বাড়ির বাইরে বা কর্মস্থলে যেতেই হবে। এসব মানুষের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি কি সরকারের বিবেচনার বাইরেই থেকে যাবে?
গত প্রায় ২১ মাসের মহামারি জীবনে লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধ সাধারণ মানুষের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। টিকাকরণও এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ। যদিও টিকাকরণ মানেই করোনা থেকে রেহাই পাওয়া নয়। টিকাকরণের পরেও যে কোভিড ছড়িয়েছে, তার সাক্ষী বহু দেশ। ইজরায়েলে চার ডোজ় টিকার পরেও সংক্রমণ বেড়েছে পনেরো গুণ! জার্মানিতে তৃতীয় ঢেউ পেরিয়ে কোভিডের চতুর্থ প্রবাহে জানুয়ারিতে প্রতিদিন আক্রান্ত প্রায় এক লাখ মানুষ। আমেরিকায় দিনে দশ লাখ। প্রতিবেশী ভারত, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডেও করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
করোনা ভাইরাসের ক্রমাগত মিউটেশন চলছে, আসছে একের পর এক স্ট্রেন। কোনটা অধিক সংক্রামক, কোনটা বেশি প্রাণঘাতী, এসব তথ্য অনেকটাই অজানা। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রধান অস্ত্র মনে করা হয় মাস্ককে। ভালো মানের মাস্ক ব্যবহার, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরা ও খোলা, নিয়মিত মাস্ক পরিষ্কার করা ইত্যাদি কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসমাগম হয়- এমন স্থানে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশে এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে মাস্ক ব্যবহারে উৎসাহী করা যায়নি। শহরে অল্প কিছু মানুষ ছাড়া কেউই মাস্ক ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।
এটা অবশ্য শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, কোভিড-আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মাস্ক পরতে নারাজ নাগরিক নীতিনির্ধারকদের বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমনকি, স্বজনের মৃত্যু দেখেও কোভিড বিধি পালন করতে অনেকে অনাগ্রহী। চ্যালেঞ্জটা এখানেই। জীবনযাপনকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। যদি আমরা বাধ্য হতাম, মাস্ক ব্যবহার করতাম তাহলে ভিন্ন রকম প্রেক্ষিত তৈরি হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়েই অবশ্য একই ক্লান্তি এবং অনীহা। সেক্ষেত্রে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। মানুষ কেন এত ক্ষত ও ক্ষতি নিজচোখে দেখেও কোভিড-বিধি মানতে নারাজ? এ এক আশ্চর্য প্রবণতা! গবেষকরা বলছেন, করোনা ঠেকাতে সবাইকেই মাস্ক পরতে হবে। দেখতে হবে যাতে বন্ধ ঘরে অনেক মানুষ এক সঙ্গে না থাকেন ইত্যাদি। আর এ সব আমরা কর্তব্য হিসেবে জানি। কিন্তু তা পালন করার ধর্মটা মানছি না।
আসলে করোনাসংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত সতর্কতা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যাবতীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা সরকারের তরফে শুরু হলেই ভালো, কিন্তু নাগরিক সমাজেরও কিছু দায়িত্ব আছে। প্রয়োজনে সরকারের কাছে দাবিও পেশ করতে হবে নাগরিকদেরই। নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে সব নাগরিককেই সমানভাবে তৎপর হতে হবে।
গত ২১ মাসে করোনার দুটি ঢেউ বুঝিয়ে দিয়েছে যে, যুদ্ধের কৌশলেও পরিবর্তন চাই। কেবল গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাফেরাসহ কিছু খাপছাড়া বিধিনিষেধ দিয়ে তৃতীয় প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। সুস্থ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে। স্বাস্থ্যকর্মী বলতে শুধু ডাক্তার, নার্স, বা হাসপাতালের অন্য কর্মী নন, গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার স্বাস্থ্যকর্মীরাও।
এই স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর কেবল কাজ চাপালেই হবে না, তাদের অভিজ্ঞতা, পরামর্শও শুনতে হবে। কারণ কোথায়, কীভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, কারা রয়ে যাচ্ছেন টিকার বাইরে, তা তাদের মতো কেউ জানে না। এসব স্বাস্থ্যকর্মী ও সর্বস্তরের সরকারি কর্মীদের এখন শুধু কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ দেয়াই যথেষ্ট নয়। কর্মক্ষেত্রে এবং পরিবার-প্রতিবেশে কোভিড পজিটিভ মানুষ থাকবেন, কী করে স্বাভাবিক জীবন-জীবিকার সব কর্তব্য পালন করা যায়, সে বিষয়েও তাদের অবহিত করা চাই।
কারণ কোভিড সহজে যাবে না। বার বার মিউটেশন মানেই নতুন নতুন স্ট্রেন, সংক্রমণের ঢেউ বার বার। আগে থাকতে যুদ্ধের রূপরেখা ঠিক করা থাকলে পালে বাঘ পড়লে খাঁচাবন্দি করতে সময় লাগে কম। তাই প্রয়োজন নানা প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট কোভিড-বিধি। স্কুলে একজন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হলেই কি গোটা স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে?
একজন কর্মী আক্রান্ত হলেই স্তব্ধ হবে গোটা দপ্তর? এতদিনে বোঝা গিয়েছে যে, স্কুল বন্ধ রাখলে শিশুরা নিরাপদ, এই ধারণাও একটা সময়সীমার পরে আর কাজ করে না। গত দুবছরে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। লেখাপড়া তো বটেই, স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগও রয়েছে। ঘরে থেকে শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে।
সংক্রমণ সত্ত্বেও কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়, এর একটা উদাহরণ তো চোখের সামনেই রয়েছে— হাসপাতাল। অসংখ্য ডাক্তার আক্রান্ত হচ্ছেন, তা সত্ত্বেও চিকিৎসা পরিষেবা চালু থাকছে। নানা কৌশল বের করা হচ্ছে। এখন যেমন স্বাস্থ্য দপ্তর ব্যবস্থা করেছে যে, মেডিসিন, স্ত্রীরোগ, সার্জারি ও অন্য ক্লিনিক্যাল বিভাগে সব ডাক্তার একসঙ্গে রোগী না দেখে, ভাগ করে রোগী দেখবেন।
অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের অভাব কমাতে ননক্লিনিক্যাল বিষয়ের ডাক্তাররাও এগিয়ে আসবেন। জুনিয়রদের পাশাপাশি সিনিয়ররাও আর একটু দায়িত্ব নিন। কোভিড ও ননকোভিড ইমার্জেন্সি শুধু নয়, ফিভার ক্লিনিকে, সাধারণ আউটডোরে এই চিকিৎসকদের কাজে লাগানো হোক। প্যারামেডিক্যাল কর্মীরা টিকা দিতে, কোভিড টেস্ট করতে, চিকিৎসাতে ডাক্তারদের সাহায্য করতে পারেন অনেকটাই। টিকাকরণের দায়িত্ব নিন জনস্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরাও।
করোনার অব্যাহত ঢেউ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষের সম্মিলিত ভূমিকা, সুচিন্তিত উদ্যোগ। এই ঢেউটা পার করে দিতে পারলেই কোভিড-পর্ব সামাল দেয়া যাবে, এই মনোভাব নিয়ে যদি কাজ করে সরকার বা নাগরিকসমাজ, তা হলে বুঝতে হবে, মহামারি থেকে আমরা আসলে কিছুই শিখিনি।
লেখক: প্রবন্ধকার-সাবেক ছাত্রনেতা, রম্য লেখক।