বর্ষার সময় শহর কিংবা গ্রামের খাল-বিল, নদ-নালা, ডোবা ও অন্যান্য জলাশয়ের তীর দিয়ে হাঁটলে চোখে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য—নদীর জলে ভেসে চলা অসংখ্য রিং বা চায়না দুয়ারি জাল। এই জালগুলো নানা আকৃতিতে তৈরি, যার মধ্যে মাছের পোনা, ছোট মাছ, এমনকি অন্য জলজ প্রাণীও আটকে পড়ে। অথচ সরকারিভাবে এই জাল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবুও বিক্রেতা এবং জেলেরা এই জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছে—যা দেশের জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাল, বিল, ডোবা এবং নদীতে মোট ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ দেখা যায়। এর মধ্যে ছোট মাছের সংখ্যা ১৪৩ প্রজাতি। উল্লেখযোগ্য প্রজাতির মধ্যে আছে—মলা, ঢেলা, চেলা, পুঁটি, শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, কাজলি, বাতাশি, টেংরা, বাচা, টাকি, চেং, কাকিলা, বোটা, ভাংনা, টাটকিনি, বৌ-মাছ, চাপিলা, বাইম, খলিশা, কৈ, বেলে, চান্দা, চিংড়ি। তবে এদের মধ্যে ১২ প্রজাতি চরম বিপন্ন, ২৮ প্রজাতি বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।অতীতে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ে দেশীয় মাছের প্রাচুর্য ছিল অপরিসীম। গ্রামের মানুষজন তাদের দৈনন্দিন জীবিকা, খাদ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এসব মাছের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস, রাসায়নিক ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, খাল-বিল ভরাট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশীয় মাছের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এই সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জালের অবাধ ব্যবহার।রিং বা চায়না জাল এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, একবার মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণী জালে আটকে গেলে তারা মুক্ত হতে পারে না। মাছ শিকারিরা প্রয়োজনীয় মাছ রেখে বাকি মাছ এবং জলজ প্রাণী ধ্বংস করে ফেলে। বিশেষ করে বোয়াল, পাবদা, গুচি, চেংড়ি, ময়া, টেংরা, টাকি মাছের পোনা ও ছোট মাছ বিলুপ্তির পথে। এভাবে অবৈধ মাছ শিকার শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে না, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও প্রভাব ফেলছে।এ ধরনের অবৈধ শিকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কার্যক্রম সময়ে সময়ে সীমিত। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘মানুষ দেখানো’ অভিযান হলেও, বাস্তবে শাস্তি কার্যকর হয় না। ফলে জেলেরা আরও বেপরোয়া হয়ে এই নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করছে। নদী ও খাল থেকে মাছের পোনা এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী ধ্বংসের এই প্রক্রিয়ার কারণে ভবিষ্যতে মুক্ত জলাশয়ে মাছের অভাব এবং প্রজাতির বিলুপ্তি নিশ্চিত।রিং জাল ব্যবহার শুধু মাছের পোনা ও ছোট মাছ ধ্বংস করছে না, বরং জলজ জীববৈচিত্র্যকে পুরোপুরি বিপন্ন করে দিচ্ছে। এই জাল দিয়ে মাছ শিকারের সময় একবার জালে আটকে গেলে মাছ সহ জলজ প্রাণী দীর্ঘ সময় বন্দি থাকে। পরিশেষে শিকারীরা প্রয়োজনীয় মাছ রেখে বাকি মাছ ও অন্যান্য প্রাণী মেরে ফেলে। ফলে এক ধরনের ‘মরণ ফাঁদ’ তৈরি হচ্ছে, যা পরিবেশ এবং মাছ সংরক্ষণের জন্য একেবারে ধ্বংসাত্মক।পেশাদার ও সৌখিন মৎস্য শিকারিরা এই জাল ব্যবহার করে বড় আয়ের লক্ষ্য রাখলেও দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভবিষ্যতের প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করছে। এ কারণে সরকারের দায়িত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আইনগত ব্যবস্থা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা, অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচলিত মাছ শিকারের নিয়মাবলি মেনে চলা নিশ্চিত করা জরুরি।একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। নদী, খাল, বিল ও জলাশয়ে মৎস্য শিকারের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা না হলে, আমাদের ভবিষ্যতের প্রজন্মের খাদ্য ও জীবিকাশ্রয় হুমকির মুখে পড়বে। সরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় জাল উচ্ছেদ, মাছের প্রজনন রক্ষা, এবং স্থানীয় জেলেদের প্রায়শঃ নিরাপদ ও বৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকার করার জন্য সহযোগিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।একসময় দেশীয় জালের পরিবর্তে কারেন্ট জাল ও সুতি জাল ছিল মৎস্যজীবীর মূল সম্বল। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিক ও নতুন ধরনের মাছ শিকারের যন্ত্রপাতি চলে এসেছে। কিন্তু এসব আধুনিক ফাঁদে মাছ শিকার করতে গিয়ে ছোট-বড় সব ধরনের মাছের পোনা ও অন্য জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পেশাদার ও সৌখিন শিকারিরা নিজেদের সুবিধার্থে মাছ শিকার চালাচ্ছে, যা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।যে কোনো প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে প্রশাসনিক তৎপরতা, আইন প্রয়োগ ও জনগণের সচেতনতার ওপর। রিং বা চায়না জাল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও এটি কার্যকরভাবে ধ্বংস না করলে ভবিষ্যতে দেশের জলজ প্রাণীর বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এজন্য সরকারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর এবং সাধারণ জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।নদী, খাল, বিল এবং জলাশয় শুধু মাছের উৎস নয়, বরং আমাদের জীবিকাশ্রয় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। এগুলো রক্ষা না করলে আমরা কেবল খাদ্য নিরাপত্তা হারাব না, বরং দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হবে। রিং বা চায়না জাল ধ্বংস করে দেশের জলজ প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের অন্যতম জরুরি দাবি।যদি অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের নদী-বিল থেকে দেশীয় মাছের প্রজননশীল পোনা বিলুপ্ত হতে পারে। এটি শুধুমাত্র মৎস্যশিল্পের জন্য নয়, দেশের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও এক বিরাট সংকট। তাই সচেতনতা, আইনের কঠোর প্রয়োগ, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে রিং বা চায়না জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে—এটাই একমাত্র সমাধান।
সেলিম রানা, কলামিস্ট