বসবাসের অযোগ্যতার বিচারে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্ব র্যাংকিংয়ের তলানিতেই থাকে। যদিও গত বছরের জুনে ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর সবশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান হয় চতুর্থ। ২০১৯ সালের তালিকায় ঢাকা ছিলো তৃতীয়। অর্থাৎ ওই বছর এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী বসবাসের অযোগ্যতার বিচারে ঢাকার আগে রয়েছে পাপুয়া নিউ গিনির পোর্ট মোরেসবি, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক এবং নাইজেরিয়ার লাগোস। তার মানে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কোনো শহরও ঢাকার আগে নেই।
তৃতীয় অবস্থান থেকে চতুর্থ অবস্থানে উঠে আসাটাকে উন্নতি অথবা অগ্রগতি হিসেবে দেখা হবে কি না— সেই প্রশ্নের সুরাহা করার আগেই গত ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ১০০টি প্রধান শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের দিক দিয়েও ঢাকা শীর্ষে। আবার এর কদিন পরেই নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) গবেষণায় জানিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বের দিক দিয়েও এগিয়ে আছে ঢাকা।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া এক চিঠিতে জনঘনত্বের চিত্র তুলে ধরে বিআইপি বলছে, রাজধানীর লালবাগ, বংশাল, গেন্ডারিয়া ও সবুজবাগে প্রতি একরে ৭ থেকে ৮শ মানুষ বাস করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। সুতরাং, যে শহরের প্রতি একরে ৭ থেকে আটশ মানুষ বসবাস করে, সেই শহরে নাগরিকের জীবনমান কেমন হবে; সেই শহরটিকে কতটা বসবাসযোগ্য করা যাবে; সেই শহরের বায়ু কতটা পরিশুদ্ধ রাখা যাবে— তা সহজেই অনুমেয়।
এই মুহূর্তে ঢাকার বিরাট অংশই মেট্রোরেলসহ অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে ধূলিময়। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা সংকুচিত হওয়ায় এবং নানা কারণে রাস্তা কেটে রাখায় ভয়াবহ জটের কথা প্রতিনিয়তই নাগরিকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন। অনেকে যান বা জনজটের ভয়াবহ দৃশ্যের ছবি তুলেও আপলোড করেন। তার মানে কি আমরা মেট্রোরেল বা এরকম উন্নয়ন চাই না? অবশ্যই চাই। তবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে যদি নাগরিককে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সেই পরিকল্পনাটি ত্রুটিপূর্ণ।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তার মতো হতে থাকবে। কিন্তু সেখানে নাগরিকদের যাতে দুর্ভোগ না হয় কিংবা দুর্ভোগটি যেন সীমাহীন না হয়, সেই পরিকল্পনাটি সবার আগে নিতে হয়। কিন্তু আমরা শুধু উন্নয়নের একটি দিক নিয়েই কিংবা উন্নয়নের দৃশ্যমান অর্থাৎ অবকাঠামোর দিকটি নিয়েই বেশি উৎসাহী; উন্নয়নের অন্যপিঠ নিয়ে ভাবার যেন সময় নেই।
উন্নয়নের মূল্য নিয়ে আমাদের চিন্তা কম। আমরা রাস্তা নির্মাণ হলেই খুশি। কিন্তু সেই রাস্তাটি নির্মাণে উন্নত বিশ্বের চেয়েও কেন বেশি খরচ হলো; সেই ফ্লাইওভারটির নকশা কেন ত্রুটিপূর্ণ এবং এর জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচার হয়েছে কি না; অপ্রয়োজনীয় স্থানে কালভার্ট নির্মাণ; সেতু নির্মাণ করে সেখানে সংযোগ সড়ক না দেয়া; ভবন নির্মাণে বাঁশের বদলে রড দেয়ার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে কালেভদ্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়; নাগরিকরা রসিকতা করেন, কিন্তু পরক্ষণে নতুন ইস্যুর নিচে সেগুলো চাপা পড়ে যায়।
ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সেই রসিক নাগরিকদের পয়সাই খরচ হতে থাকে, পক্ষান্তরে এর বিনিময়ে মূলত কী হচ্ছে; ঢাকার বায়ু কতটা দূষিত হচ্ছে; সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক করে ফেলায় এই শহরের ওপর মানুষের চাপ বাড়তে বাড়তে একটা সময় এখানে জনঘনত্বের পরিমাণ আসলে কী দাঁড়াবে— তা নিয়ে চিন্তা করার সময় বোধ করি নীতিনির্ধাকরদের কম।
ঢাকা শহরে অতিমাত্রায় জনসংখ্যার চাপের মূল কারণ খুঁজতে গেলে মোটা দাগে তিনটি ইস্যু সামনে আসবে। ১. জীবিকা বা কর্ম, ২. শিক্ষা এবং ৩. চিকিৎসা।
শুধু বেসরকারি নয়, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকতে চান না। ঢাকার বাইরে বদলি হলে তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ঢাকায় বদলি হয়ে আসার জন্য তদবির করতে থাকেন (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। ঢাকার প্রতি কেন এত টান বা এই শহরে কী এমন মধু!
সে প্রশ্নের উত্তর হলো পয়েন্ট নম্বর ২ ও ৩। অর্থাৎ শিক্ষা ও চিকিৎসা। নাগরিকদের বিরাট অংশই মনে করে, সন্তানকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে হলে তাকে ঢাকায় থাকতে হবে। তার মানে ঢাকার বাইরে কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই? ঢাকার বাইরেই যে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি, এর প্রমাণ প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হন, তাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। কিন্তু উচ্চশিক্ষা? ঢাকার বাইরে গড়ে তোলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর বাইরে অন্যান্য উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে? কেন এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম? শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি নাকি মানসিকতায়?
ঢাকানির্ভরতার আরেকটি বড় কারণ চিকিৎসা। এখন উপজেলা পর্যায়েও সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারও গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের ধারণা এখনও ইতিবাচক নয়। একটু জটিল অসুখ কিংবা একটু সিরিয়াস দুর্ঘটনা হলেই তাকে আর উপজেলা তো বটেই, জেলা হাসপাতালেও তার চিকিৎসা হয় না। এমনকি ঢাকার বাইরে যেসব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে, সেখানের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অসন্তোষ আছে। প্রশ্ন হলো, যদি মেডিক্যাল কলেজ কিংবা জেলা ও উপজেলাপর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে গিয়ে মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত সেবা না পায়, তাহলে জনগণের পয়সায় এসব প্রতিষ্ঠান রেখে কী লাভ?
যদি এসব জায়গায় গিয়ে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা না পায় বা যদি সে ভরসা না পায়, তাহলে তাকে তো ঘুরেফিরে সেই ঢাকাতেই আসতে হয়। যদি ঢাকায় এলেই ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে— এমন ধারণা ও বিশ্বাস জনমনে বদ্ধমূল হয়, তাহলে সারা দেশের ১৭ কোটি মানুষ তো চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসবেই। অন্তত যাদের সক্ষমতা আছে। সুতরাং, মানুষকে যদি ঢাকায় আসতে বাধ্য করার পরিস্থিতির অবসান ঘটানো না যায়, তাহলে এই শহরের বায়ুমান কিংবা বসবাসযোগ্যতা নিয়ে কথা বলা বৃথা।
মানুষের ঢাকানির্ভরতার সবচেয়ে বড় কারণ জীবিকা। ঢাকায় এলেই একটা কাজ জুটে যাবে— এই যে একটা ধারণা ও বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে, এটিও এই শহরের বসবাস-অযোগ্যতার আরেকটি কারণ। একজন সাধারণ মানুষ কেন কাজের জন্য ঢাকায় আসবেন? প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরে এমন ব্যবস্থা কেন গড়ে তোলা যাচ্ছে না যাতে মানুষ নিজের বাড়ি থেকেই কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতে পারবে? এই সুযোগ থাকলে সবাইকে হুমড়ি খেয়ে ঢাকায় আসতে হতো না।
ঢাকা রাজধানী শহর। কিন্তু দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। পুরো দেশটাই ঢাকার ভেতরে। রাজধানী শহর হিসেবে এখানে প্রশাসনের অতিগুরুত্বপূর্ণ অফিস এবং বেসরকারি পর্যায়েরও অতি সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের বাইরে আর কিছুই থাকার কথা ছিল না। অথচ এই শহরের মধ্যে কল-কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিটি রাস্তার দুপাশে অগণিত হাসপাতাল। এমন বিতিকিচ্ছিরি রাজধানী শহর পৃথিবীতে বিরল। একটি শহরে দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। সুতরাং এখানে নাগরিক-সুবিধা নিশ্চিত করাও সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
এসব বাস্তবতায় বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কার্যত সেটি কাগজে-কলমে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের চেয়েও বেশি জরুরি মানুষের কাজ, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ। সাধারণ মানুষ তার নিজের এলাকাতেই যদি সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন; যদি নিজের বাড়ির কাছের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সন্তানকে ভর্তি করিয়ে নির্ভার থাকতে পারেন এবং বাড়ির কাছের হাসপাতালে গিয়েই সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা পান— তাহলে তিনি কেন ঢাকায় এসে এই শহরের বাতাস ভারী করবেন?
জেলা বা উপজেলা শহর কিংবা গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেও তার অনেক খরচ। এই খরচ তিনি করবেন বছরে একবার। পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি শুধু রাজধানীর সৌন্দর্য দেখতে আসবেন। চাকরি, শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য নয়। অর্থাৎ নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো ঢাকার বাইরে নিশ্চিত করা না গেলে আমরা প্রতিবছরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার প্রতিবেদন দেখে আহা-উহু করব এবং এই হা-হুতাশ পৌনঃপুনিকভাবে চলতে থাকবে। ঢাকা আর বদলাবে না।
ঢাকা শহরের বয়স চারশ বছর। অথচ প্রতিনিয়ত এই শহরের নির্মাণকাজ চলছে। প্রশ্ন হলো- একটা শহরের নির্মাণকাজ কত বছর চলবে? এর নির্মাণকাজ কখনও কি শেষ হবে না?
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।