বইছিল স্বাধীনতার সুবাতাস। স্লোগানে মুখরিত চারদিক, আকাশ-বাতাস। জোর গলায় উচ্চারিত হচ্ছে, ‘জয় বাংলা’, তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরজুড়ে যেন অনুরণিত হয়ে চলেছে, প্রতিধ্বনিতে একাকার। হালকা শীতের আমেজময় সেই ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। বেলা দ্বিপ্রহরের পরপরই হাজার দশেকেরও বেশি সদ্য মুক্তির স্বাদ পাওয়া আবেগে উদ্বেলিত বাঙালি সেখানে জড়ো হয়েছিল, যদিও তারা জানতেন জাতির পিতা সেখানে এসে পৌঁছবেন বিকেলে।
রুদ্ধশ্বাসে সেখানে প্রতীক্ষায় রয়েছেন সবাই, প্রতীক্ষায় সেই মহানায়কের, যিনি এই মাটির স্বাধীনতা এনেছেন, যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আর উদাত্ত আহ্বানে সবাই নেমেছিলেন মুক্তি ছিনিয়ে আনার যুদ্ধে। শত ত্যাগ তিতিক্ষা, অশ্রুপাত, রক্তপাত, মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এনেছেন তারা। সেই মহানায়ককে নিজ দেশের মাটিতে স্বাগত জানাতে তাই এত আয়োজন। অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়ানো লাইনে সবার মুখে উৎকণ্ঠা, অস্থিরতা যারা যুদ্ধ করেছিলেন, গঠন করেছিলেন যুদ্ধকালীন সেই মুজিবনগর সরকার। তরুণ ছাত্রনেতাদের মধ্যেও আবেগ। সবাই তাদের হৃদয়ের বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা কমেট বিমানটি যে মুহূর্তে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল, যেন কোনো জাদুময় কিছু ঘটে গেল। প্রতীক্ষাধীন লাখো জনতা যেন অপেক্ষা করে ছিল অনন্তকালের জন্য, তার সমাপ্তি ঘটল। শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
বঙ্গবন্ধু তার নতুন মহিমায় এলেন, এ যেন, ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’। ‘ভদ্র মহোদয়গণ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমি জীবিত এবং সুস্থ’, বাংলার সেই নেতা বললেন আনন্দিত স্বরে, নানা মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে ‘পাকিস্তানের বন্দি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল তার বন্দিদশার দিনগুলোতে। তিনি দেশে ফেরার দুদিন আগে লন্ডনের ক্লারিজেসে একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। জানুয়ারির ৮ তারিখে পাকিস্তানের নতুন নেতা তাকে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির চাকালা বিমানবন্দরে বিদায় জানান।
বাংলাদেশের উদ্দেশে উড্ডয়নের পর, ভুট্টো মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্য নাইটিঙ্গেল হ্যাজ ফ্লোউন’। অবতরণের পরে বঙ্গবন্ধুকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক ক্লেদাক্ত দীর্ঘ ১০ মাস পাকিস্তানে বন্দিদশায় কাটাবার ক্লান্তির ছাপ। আর উৎসুক জনতার উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে আর গগনফাটা জয়োল্লাস ও অভিবাদনে তিনি স্পষ্টতই বিহবল হয়ে পড়েন। তাকে একাত্তরের মার্চে যখন পাকিস্তানে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় সে সময়ের তুলনায় বেশ শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছিলেন। এলোমেলো, উস্কোখুস্কো চুল আর মুখে লেগে থাকা স্মিতহাসি, কপালে লেপ্টে থাকা চুলের মধ্যে তিনি আলতো হাত বুলিয়ে ঠিক করছিলেন। সারা শরীরে অবসাদের চিহ্ন। তবে চোখে দৃঢ় প্রত্যয় আর অদ্ভুত দীপ্তি যা জনতার মনোযোগের কেন্দ্রে।
তিনি কাঁদছিলেন। জনসমক্ষে বা বিশ্ববাসীর সামনে প্রথমবারের মতো ছল ছল অশ্রুসিক্ত। বিগত নয় মাসে বাংলাদেশ ও তার জনগণের উপর যে বীভৎস জুলুম, অত্যাচার গিয়েছে তার স্মরণ করে তিনি কাঁদছিলেন। তার সঙ্গে কাঁদছিল উপস্থিত জনতাও। সাত কোটি জনতা তার নিরাপত্তা নিয়ে এতদিন শঙ্কিত ছিল। তারা এতদিন কত না প্রার্থনা করেছে আবার নিজেদের মাঝে ফিরে পাওয়ার, নিরাপদে ফিরে আসার জন্য।
এর কয়েক ঘণ্টা আগে, তিনি দিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভ্যর্থনা লাভ করেন। সাত কোটি বাঙালি প্রত্যক্ষ করলেন তাদের জাতির পিতা রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করলেন। রেসকোর্সের সেই ঐতিহাসিক স্থান যেখানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল তার অমোঘ ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রাকটি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্সের এই স্বল্পদৈর্ঘের রাস্তাঘাট জনমানুষের সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। মানুষের মনে আনন্দ যেন আর ধরে না। প্রতিটি ছাদের উপরে আনন্দিত মুখের প্রতিচ্ছবি- নারী, পুরুষ আর শিশুর। কিশোর-তরুণরা আশপাশের গাছগুলোতে চড়ে বসেছিল এই জয়োৎসব প্রত্যক্ষ করতে। সবার সংলাপ সীমাবদ্ধ ছিল দুটি সহজ সরল কিন্তু কার্যকর এবং প্রেরণাদায়ক শব্দে।
সেই শীতের সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধু একাত্তরের মার্চের পরে প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে কথা বলেন। জাতি আগ্রহভরে শ্রবণ করে তার প্রাণ থেকে উঠে আসা কথামালা, যা তারা সবসময়ই করেছে। আবেগে তার গলা ধরে আসছিল, তবে তার বাগ্মী প্রকাশে তা কাটিয়ে যাচ্ছিল। আবারও জাতি একাগ্র আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন বঙ্গবন্ধুর জাগানিয়া স্লোগান ‘জয় বাংলা’।
সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে বইছিল স্বাধীনতার সুবাতাস। কিন্তু সেই সুবাতাসে বাঙালি জাতি যেন একজনের অভাব বোধ করছিল। বুঝতে দেরি হলো না আসলে সেই অভাবটা। সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে সেদিন এই মহান নেতার অনুপস্থিতি বঞ্চিত করে পূর্ণ সাত কোটি বাঙালির বিজয়ের স্বাদ আস্বাদনে।
ভয়াল ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখে হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিদ্রোহে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে বিচারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
জাতির উদ্দেশে দেয়া তার ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
বিজয়ের পরপর বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটিতে ফিরে পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে দেশের আপাময় জনসাধারণ। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দাবি ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বাঙালি জাতির পিতা।
এদিন বঙ্গবন্ধুকে একটি বিশেষ বিমানে তুলে দেয়া হয় লন্ডনের উদ্দেশে। সকাল সাড়ে ৬টায় তাদের বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেন।
ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে তিনি পরের দিন ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ তারিখ সকালেই তিনি নামেন দিল্লিতে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন।
লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। বাঙালি জাতির পিতা তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।’ তার আগমনে পূর্ণতা পায় মহান স্বাধীনতা। সেই থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পরিচালক, এফবিসিসিআই।